বাংলাদেশ ১০:৫৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
নোটিশ :

সাংবাদিক নিয়োগ চলছে,, সাংবাদিক নিয়োগ চলছে,,০১৯৯৯-৯৫৩৯৭০, ০১৭১২-৪৪৬৩০৬,০১৭১১-০০৬২১৪ সম্পাদক

     
ব্রেকিং নিউজ ::
স্কুলে শিক্ষাথীর সংখ্যা ১১,এসএসসিতে অকৃতকার্য ১১ ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি পাঠাগারের নতুন সভাপতি জহির ও সাধারণ সম্পাদক লিটন এবার চার বিভাগে হিট অ্যালার্ট জারি। বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ ১ মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার। অভিনব কায়দায় পাচারের সময় গাঁজাসহ ০১ জন কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। কুবিতে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তদন্তে কমিটি গঠন অ্যাসাইলাম আবেদন প্রত্যাখান হওয়া বাংলাদেশি নাগরিকদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে। আ.লীগের সংস্কৃতি-বিষয়ক উপকমিটির সদস্য হলেন রাবির ড. সুজন সেন দেশে গণমানুষের ভোটের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে: রাবি উপ-উপাচার্য হিন্দু শিক্ষার্থীকে শিবির আখ্যা দিয়ে হত্যার হুমকি রাবি ছাত্রলীগ নেতার আবারো তাজা প্রাণ গেল এক যুবকের। হত্যাকান্ডের মামলার আসামি শ্যুটার সহ অন্যতম ০৪ আসামিকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। মোবাইলে লুডু খেলা নিয়ে দ্বন্দ্বে শাকিব নামে এক তরুণের প্রাণ গেল। কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী চক্রের মূলহোতা লিপু ও তার ০৪ জন সহযোগী’কে ফেন্সিডিলসহ গ্রেফতার করেছে র‍্যাব। ধর্ষণ, অপহরণ ও হত্যার চেষ্টার মামলার আসামীকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব।

কমরেড অমল সেন -জসিম উদ্দিন

  • নিজস্ব সংবাদ :
  • আপডেট সময় ১২:২১:০৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৩
  • ১৬২৮ বার পড়া হয়েছে

কমরেড অমল সেন -জসিম উদ্দিন

 

 

 

 

 

 

 

কমরেড অমল সেন -জসিম উদ্দিন
১৯১৪ সনে নড়াইল জেলার আফরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন সম্ভ্রান্ত এক জমিদার পরিবারে। ডাক নাম বাসু। পিতাঃ জিতেন সেন, মাতাঃ চন্দ্রমুখী দেবী। সাত ভাই, তিন বোনের মধ্যে বাসু দ্বিতীয়। লেখাপড়ায় অত্যন্ত মেধাবী সাধারণ ১০জন থেকে একেবারে আলাদা। ১০ বৎসর বয়সে ১৯২৪ সালে বাসু প্রথম স্কুলে ভর্তি হন একবারে চতুর্থ শ্রেনীতে।
১৯২৭ সালে ৭ম শ্রেনীতে পড়াকালীন যশোর-খুলনা ইউথ এসোসিয়েশন এর সাথে যুক্ত হন।
১৯২৮ সালে অষ্টম শ্রেণীতে পড়াবস্থায় অমল সেনের সাথে পরিচয় হয় নড়াইল উজিরপুরের বর্ষিয়ান নেতা অনুশীলন পার্টির স্বাধীনতাবাদী সুশীল বসুর সাথে এবং তিনি অনুশীলন পার্টির সক্রিয় কর্মী হয়ে ওঠেন।নবম শ্রেণীতে পড়াকালীন বৃটিশ বিরোধী সংগ্রামে যুক্ত হয়ে অনুশীলন সমিতির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন।
১৯৩০ সালে অমল সেন খুলনা জিলা স্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিক পাস করেন।
১৯৩২ সালে নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। এ কলেজে পড়াকালে সুশীল বসুর কাছে সসস্ত্র সংগ্রামের তালিম গ্রহন করলেও তিনি মার্কসবাদের পথ খুঁজে পান। তিনি সচেতনভাবে নিজের চিন্তা চেতনাকে মার্কসবাদী আদর্শে শানিত করতে থাকেন। মেধাবী ছাত্র হিসাবে ও পারিবারক ইচ্ছানুযায়ী কথা ছিল জার্মানীতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যাবেন। কিন্তু বিপ্লবী অমল সেন সেপথে আর পা বাড়ালেন না।
১৯৩৩ সালে দৌলতপুর বিএল কলেজে অঙ্কশাস্ত্রে অনার্সে ভর্তি হন। কলেজে লেখাপড়ার পাশাপাশি তিনি মার্কসবাদের পথ ধরে হাঁটতে শুরু করেন। গণজাগরনের পথই শুধু নয়, শ্রমিক-কৃষকের ঐক্যবদ্ধ গণশক্তিই মুক্তির একমাত্র হাতিয়ার। এই চিন্তার আলোকে তার সাথী হয়ে উঠলেন যশোরের অধীর ঘোষ, অধীর ধর, সন্তোষ ঘোষ, শান্তিময় ঘোষ (বাচ্চু দা) প্রমুখ। ঘনিষ্ট এই বন্ধুদের সাথে মিলে ক্লাসের পড়ার বাইরে পড়তে থাকেন নানা ধরনের রাজনৈতিক বই পুস্তক ও নানা দেশের ইতিহাস।
৩৩এর শেষ ভাগে তদানিন্তন খুলনা-যশোরকে নিয়ে গড়ে ওঠে পার্টির জেলা কমিটি, নড়াইলের এগারখান অঞ্চলে তাঁকে কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি এগারোখান অঞ্চলের গোবরা, আগদিয়া, স্বরশপুর, মাইজপাড়া, তোলারামপুর, ধলগ্রাম, নারিকেল বাড়িয়া হাটের হাটখাজনার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। এ আন্দোলন কৃষক জনগণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগায় এবং আন্দোলন সংগঠিত রূপ নেয়। ঐ সময়ের স্বরশপুরের মৎসজীবীদের আন্দোলন, মৎসজীবী জনগণের কাছে এক অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে দেখা দিয়েছিল।
জমিদারদের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্ব ও তাঁর নিজের পিতার জমিদারির বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলন তাঁকে ঐ অঞ্চলে কিংবদন্তীর নেতা হিসাবে পরিচিত করে তোলে।তিনি হয়ে উঠেন সকলের প্রিয় “বাবুদা” হিসাবে।
কমরেড অমল সেন ১৯৩৫ সনে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন।
সমাজে জাতপাতের যে বিভাজন আর শ্রেণীশোষণ প্রত্যক্ষ করেছেন অমল সেন তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে নিজের অবস্থান দৃঢ় করতে হবে। শোষিত জনগণই পারে শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। নিজের পরিবার পরিজনের বিরুদ্ধে তাঁকে লড়াই করতে হবে সেটা তিনি বুঝে ফেলেছেন এবং ঐ বাড়ীতে থেকে সেটা সম্ভব না সেটাও তিনি বুঝে ফেলেছিলেন। “লাঙ্গল যার জমি তার” এই শ্লোগান নিয়ে অবশেষে বেরিয়ে পড়লেন বাড়ী ছেড়ে।
গৃহত্যাগ : ১৯৩৭ সালে তিনি নিজ পরিবার ত্যাগ করে শ্রেণীচ্যুত হয়ে বাকড়ীর ১১ খানের রসিকলাল ঘোষের বাড়ীতে চলে
আসেন। ঐ যে বেরিয়ে এলেন, আর কখনো অধিকার নিয়ে নিজের জমিদার বাড়ীতে ফিরে যাননি। তিনি হয়ে গেলেন সবর্হারা। মার্কসীয় ভাষায় যাকে বলে শ্রেনীচ্যুত।
অমল সেন যখন এগারোখান অঞ্চলে গেলেন তখন ঐ অঞ্চলের অবস্থা আদৌ ভালো ছিল না। লেখাপড়া, যোগাযোগ, চেতনা-উপলব্ধি, জীবনাচরণ বলতে গেলে কোনটাই ছিলনা। নিরন্ন খেটে খাওয়া মানুষগুলিকে জাতে তোলার জন্য কৃষক সংগ্রামের পাশাপাশি বাকড়ী হাই স্কুলে শিক্ষকতার কাজ শুরু করেন।
১৯৪২ সাল সারা ভারতবর্ষ জুড়ে এক অস্থির অবস্থা। শুরু হয় ২য় বিশ্বযুদ্ধ। খুলনা-বরিশাল-যশোর অঞ্চলকে নিয়ে গঠিত হয় গেরিলা টিম। কমরেড অমল সেন সে টিমের সদস্য হন। ঐ সময় একদিকে যুদ্ধের বিভিষিকা অন্যদিকে সাইক্লোন, ভারত ছাড়ো আন্দোলন, জাপানী বিমানের বোমাবর্ষণ, একের পর এক গণবিক্ষোভ, পুলিশের সাথে খন্ডযুদ্ধ, শ্রমিক আন্দোলন ও ধর্মঘট, কলকাতা দাঙ্গা, নোয়াখালি স্বাধীনতা, প্রাকৃতিক বন্যা- এসব কারনে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ, যার নাম দেয়া হয়েছিল মম্মন্তর। দুর্ভিক্ষের কারনে তখন সারা ভারত জুড়ে একটা হাহাকার অবস্থা শুরু হয়েছিল। হাজার হাজার মানুষ না খেয়ে মরতে বসেছিল। দুর্ভিক্ষ পিড়ীতদের সহায়তার জন্য সাহায্য সহযোগিতার আয়োজন করতে ত্রান কমিটি গঠন করতে হয়। অমল সেনের নেতৃত্বে বাড়ী-বাড়ী ঘুড়ে গান-বাজনা, নৃত্য-গীত করে টাকা-পয়সা সংগ্রহ করে আবার বাড়ী বাড়ী গিয়ে তা দুঃস্থদের মধ্যে বিলায়ে এ অঞ্চলের গরীব মানুষের পাশে দাড়িয়েছিলেন।
তেভাগা আন্দোলন ১৯৪৫-৪৬ : বৃটিশ শাসনামলে চিরস্থায়ী ভূমী বন্দোবস্তের ফলে ভারতবর্ষ জুড়ে যে ভূ-স্বামী গোষ্ঠীর জন্ম হয়েছিল তাদের বেশীর ভাগই ছিল নগরবাসী ও উচ্চবর্ণের হিন্দু। তারা তাদের জমিদারী থেকে ছিল বিচ্ছিন্ন তাই তাদের জমিজমা ব্যবস্থাপনা করতো তাদের নিয়োজিত স্থানীয় এজেন্টরা। জমির সঙ্গে এদের সাথে মূল সম্পর্ক ছিল ব্যবসাভিত্তিক। বৃটিশ শাসককে নির্ধারিত খাজনা দেওয়ার পর বর্গাদার থেকে আদায়কৃত খাজনার সম্পূর্ণ লভ্যাংশ তাদেরই থাকতো। এরা বন্দোবস্ত জমি খাজনা বা ভাগচাষের বিনিময়ে বন্দোবস্ত দিত কৃষকদের কছে। ভাগচাষী কৃষকরা ছিলেন মুসলমান এবং নমশুদ্র। ভাগচাষের সম্পর্ক বাদেও এদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল প্রজা-মনিবের । মুসলমান এবং নমশুদ্র কৃষকদের উপর বর্ণ হিন্দুদের অর্থনৈতিক শোষণ ছিলো তীব্র। কৃষকদেরকে অবজ্ঞা এবং তাচ্ছিল্য করতেন তারা।
জমির উপর কৃষকদের কোনরকম অধিকার ছিলনা, শুধুমাত্র ভাগচাষের বিনিময়ে উৎপাদিত ফসলের পঞ্চাশ ভাগ ফলন দিয়ে দিতে হতো ভূস্বামী বা জোতদারের হাতে। উৎপাদিত ফলনের অর্ধেক অথবা আধা দিয়ে দেয়ার কারনে একে বলা হতো আধি চাষ, আর যারা এ চাষের সাথে জড়িত তাদের বলা হতো আধিয়ার। এ প্রথা পশ্চিমবঙ্গে বর্গা, বীরভূমে কিসানী এবং ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা অঞ্চলে টংক নামে পরিচিত ছিল। বাংলার সর্বত্রই এ প্রথা প্রচলিত ছিল। আধি চাষ প্রথার ফলে ভূ-স্বামী আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হতে থাকলো আর কিছু কিছু বর্গা চাষী কোনরকম খেয়ে পড়ে বেঁচে বর্তে থাকলেও অধিকাংশ চাষীরা ক্রমান্বয়ে নিস্বঃ হতে শুরু করলো, অধিকাংশরা ঋনগ্রস্থ হয়ে পড়লো। খাজনা বাকী পড়ায় জোতদাররা অমানসিক অত্যাচার নির্য়াতন শুরু করলো। দিনে দিনে তাদের অত্যাচার নির্য়াতন বেড়ে চললো। এতে কৃষকদের মধ্যে ক্ষোভ দানা বাধতে শুরু করে। কৃষকদের মধ্যে শুরু হয় আন্দোলন। সে আন্দোলন আস্তে আস্তে চরম আকার ধারন করে যা তেভাগা আন্দোলন নামে পরিচিত।
১৯৪৬ সালের সেই ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন জন নেতৃত্ব দিলেও বৃহত্তর নড়াইল-যশোরে নেতৃত্ব দেন কমরেড অমল সেন।
তেভাগা আন্দোলনের ফসল ঘরে উঠতে না উঠতেই ১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতী তত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান দু-ভাগে ভাগ হয়ে যায়। দেশ বিভাগের পর থেকেই অমল সেনরা পাকিস্তানী মুসলিম লীগ সরকারের রোষানলে পড়েন। চলে যান আত্মগোপণে।
১৯৪৮ সনে কমরেড অমল সেন যশোর কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক নিযুক্ত হন। এ সময়ই কমরেড রনদীভের বাম হঠকারী “দালাল হালাল লাইন” প্রয়োগের ফলে নড়াইলের কৃষক এলাকাগুলোতে এবং পার্টির কর্মীদের ওপর বর্বরোচিত আক্রমণ শুরু হয়। ডুমুরতলার নুরুল হুদা, বড়ন্দারের শ্যামা কামার, বাকড়ীর পুলিনকে পাটির নির্দেশে হত্যা ও আহত করা হয়। কমরেড অমল সেন দালাল হালাল লাইনের (রনদীভের বাম হঠকারী লাইনের) বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। এ কারণে কলকাতা পার্টি কংগ্রেস থেকে ফিরে এসেই দেখতে পান যে, তাকে যশোর জেলা সম্পাদকের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
এসব কারনে ও তেভাগা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার অজুহাতে অমল সেন ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানী মুসলিম লীগ সরকারের রোষানলে পড়ে কারারুদ্ধ হয়ে যান এবং ১৯৫৬ সন পয়র্ন্ত জেলে আটক থাকেন।
১৯৫৬ সালের শেষভাগে মুক্ত হয়ে ১৯৫৮ পয়র্ন্ত দুবছর জেলের বাইরে থাকেন- এ দু বছর তিনি শিক্ষকতা পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। কারন ঐ সময় কৃষক পরিবারের ছেলেমেয়েদের মধ্যে শিক্ষার হার খুবই কম ছিলো। চাকুরিজীবির হারও অতি কম, নেই বললে চলে। জেল থেকে মুক্তি লাভের পর তিনি এই বিষয়ের উপর জোড় দিলেন যে, শিক্ষা ছাড়া জাতীর অগ্রগতি সম্ভব নয়, তাই তিনি শিক্ষকতা পেশায় আত্মনিয়োগ করলেন। তিনি বুঝতে পারলেন একজন আদর্শ শিক্ষক অনেকগুলো আদর্শ ছাত্র-ছাত্রী তৈরি করতে পারেন। তাই বিভিন্ন উদ্যেগের পাশাপাশি নিজেই বাকড়ী স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যেই শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি একজন আদর্শ শিক্ষক হয়ে ওঠেন।
১৯৫৮ সনে সামরিক আইন জারির পর তিনি পুণরায় গ্রেফতার হয়ে জেলে চলে যান এবং দীর্ঘ ১০ বৎসর একটানা কারা ভোগের পর ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি কারামুক্ত হন। মুক্তি পাওয়ার পরপরই তিনি পার্টির যশোর জেলা কমিটির সদস্য হিসেবে নড়াইল অঞ্চলের দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। তাই স্বৈরাচারী সরকার তাঁকে বেশীদিন বাইরে থাকতে দেয়নি। তিনি আবারও কারারদ্ধ হন। উনসত্তুররে গণঅভ্যুত্থানরে সময় কিছুদিনের জন্য মুক্তি লাভ করলও আবার তিনি গ্রফেতার হয়ে যান।
১৯৭১ এর মার্চ মাসে জনগণ জেল ভেঙ্গে তাকে মুক্ত করেন। দীর্ঘ্ ১৯ বছর জেল জীবন অতিবাহিত করে আজীবন বিপ্লবী, অকৃতদার, নিঃস্বার্থ বিপ্লবী এ নেতা মুক্ত হয়ে ভারতে চলে যান এবং বাম আন্দোলনের কর্মীদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করতে খোলা চিঠি দিয়ে আহ্বান জানান। এরপর ভারতে বসেই বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটি গড়ে তোলেন এবং মুক্তিযুদ্ধে সংগঠকের দ্বায়িত্ব পালন করেন।
স্বাধীনতার পর তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং ১৯৭২ সনে চীন-মস্কো ধারার বিপরীতে লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলেন এবং সাধারণ সম্পাদক হিসাবে নির্বাচিত হন।
রাজনৈতিক জীবনে তিনি তার সময়ে বাম-ডান বিচ্যুতির বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট কর্মীদের সমাজ বিপ্লবের দিশা দেখিয়েছেন। তিনি তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা ও দর্শনের ভিত থেকে কিছু মূল্যবান প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন- “জনগণের বিকল্প শক্তি” তার মধ্যে অন্যতম।
১৯৭৭ সনে প্রকাশ করেন ”কমিউনিস্ট বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সমস্যা প্রসঙ্গে” নামক প্রবন্ধটি। এরপর কমিউনিস্ট পার্টি এবং জীবনবোধের অনুশীলনে ”কমিউনিস্ট জীবন ও আচরণ রীতি প্রসঙ্গে”। তেভাগা আন্দোলন নিয়ে ”নড়াইল তেভাগা আন্দোলনের সমীক্ষা” নামক একটি অতি মূল্যবান প্রবন্ধ রচনা করেন।
১৯৮০ সালে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (লেনিনবাদী) বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি নাম ধারণ করে এবং তিনি ওয়ার্কার্স পার্টির মহাসচিব নির্বাচিত হন ।
১৯৮৮ সালে ৬ পার্টির সমন্বয়ে গড়ে ওঠে ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ। কমরেড সেন এ পার্টির কে›ন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৯২ সালে ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, সাম্যবাদী দল ও ওয়ার্কার্স পার্টি ঐক্যবদ্ধ হয়ে গঠিত হয় ”বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পাটি”। কমরেড অমল সেন ঐক্যবদ্ধ ওয়ার্কার্স পাটির্ সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯৯৫ সালের পার্টি কংগ্রেসে তিনি পুনরায় ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি নির্বাচিত হন।
তাঁর জীবিতাবস্থায় সর্বশেষ ২০০০ সালে অনুষ্ঠিত পার্টি কংগ্রেসে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন।
নিঃস্বার্থবাদী, আজীবন কমিউনিস্ট বিপ্লবী এই নেতা ২০০৩ সনের ১৭ জানুয়ারী (৪ মাঘ ১৪০৯ বাংলা) ৮৯ বছর বয়সে ঢাকার কমিউনিটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
কমরেড অমল সেন আজীবন যে গ্রামের মাটি ও মানুষের জন্য সংগ্রাম করেছিলেন সে গ্রামের বাকড়ী স্কুল প্রাঙ্গনে তাকে চির-সমাহিত করা হয়।
কমরেড অমল সেনের জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে এদেশের বিপ্লবী আন্দোলনকে আরো এগিয়ে নিতে হবে। কমরেড অমল সেন লাল সালাম।
জসিম উদ্দিন
এভিপি ডিজাইন
এটিএন বাংলা
১৭ জানুয়ারী ২০১৬
জনপ্রিয় সংবাদ

স্কুলে শিক্ষাথীর সংখ্যা ১১,এসএসসিতে অকৃতকার্য ১১

কমরেড অমল সেন -জসিম উদ্দিন

আপডেট সময় ১২:২১:০৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৩

 

 

 

 

 

 

 

কমরেড অমল সেন -জসিম উদ্দিন
১৯১৪ সনে নড়াইল জেলার আফরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন সম্ভ্রান্ত এক জমিদার পরিবারে। ডাক নাম বাসু। পিতাঃ জিতেন সেন, মাতাঃ চন্দ্রমুখী দেবী। সাত ভাই, তিন বোনের মধ্যে বাসু দ্বিতীয়। লেখাপড়ায় অত্যন্ত মেধাবী সাধারণ ১০জন থেকে একেবারে আলাদা। ১০ বৎসর বয়সে ১৯২৪ সালে বাসু প্রথম স্কুলে ভর্তি হন একবারে চতুর্থ শ্রেনীতে।
১৯২৭ সালে ৭ম শ্রেনীতে পড়াকালীন যশোর-খুলনা ইউথ এসোসিয়েশন এর সাথে যুক্ত হন।
১৯২৮ সালে অষ্টম শ্রেণীতে পড়াবস্থায় অমল সেনের সাথে পরিচয় হয় নড়াইল উজিরপুরের বর্ষিয়ান নেতা অনুশীলন পার্টির স্বাধীনতাবাদী সুশীল বসুর সাথে এবং তিনি অনুশীলন পার্টির সক্রিয় কর্মী হয়ে ওঠেন।নবম শ্রেণীতে পড়াকালীন বৃটিশ বিরোধী সংগ্রামে যুক্ত হয়ে অনুশীলন সমিতির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন।
১৯৩০ সালে অমল সেন খুলনা জিলা স্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিক পাস করেন।
১৯৩২ সালে নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। এ কলেজে পড়াকালে সুশীল বসুর কাছে সসস্ত্র সংগ্রামের তালিম গ্রহন করলেও তিনি মার্কসবাদের পথ খুঁজে পান। তিনি সচেতনভাবে নিজের চিন্তা চেতনাকে মার্কসবাদী আদর্শে শানিত করতে থাকেন। মেধাবী ছাত্র হিসাবে ও পারিবারক ইচ্ছানুযায়ী কথা ছিল জার্মানীতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যাবেন। কিন্তু বিপ্লবী অমল সেন সেপথে আর পা বাড়ালেন না।
১৯৩৩ সালে দৌলতপুর বিএল কলেজে অঙ্কশাস্ত্রে অনার্সে ভর্তি হন। কলেজে লেখাপড়ার পাশাপাশি তিনি মার্কসবাদের পথ ধরে হাঁটতে শুরু করেন। গণজাগরনের পথই শুধু নয়, শ্রমিক-কৃষকের ঐক্যবদ্ধ গণশক্তিই মুক্তির একমাত্র হাতিয়ার। এই চিন্তার আলোকে তার সাথী হয়ে উঠলেন যশোরের অধীর ঘোষ, অধীর ধর, সন্তোষ ঘোষ, শান্তিময় ঘোষ (বাচ্চু দা) প্রমুখ। ঘনিষ্ট এই বন্ধুদের সাথে মিলে ক্লাসের পড়ার বাইরে পড়তে থাকেন নানা ধরনের রাজনৈতিক বই পুস্তক ও নানা দেশের ইতিহাস।
৩৩এর শেষ ভাগে তদানিন্তন খুলনা-যশোরকে নিয়ে গড়ে ওঠে পার্টির জেলা কমিটি, নড়াইলের এগারখান অঞ্চলে তাঁকে কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি এগারোখান অঞ্চলের গোবরা, আগদিয়া, স্বরশপুর, মাইজপাড়া, তোলারামপুর, ধলগ্রাম, নারিকেল বাড়িয়া হাটের হাটখাজনার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। এ আন্দোলন কৃষক জনগণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগায় এবং আন্দোলন সংগঠিত রূপ নেয়। ঐ সময়ের স্বরশপুরের মৎসজীবীদের আন্দোলন, মৎসজীবী জনগণের কাছে এক অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে দেখা দিয়েছিল।
জমিদারদের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্ব ও তাঁর নিজের পিতার জমিদারির বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলন তাঁকে ঐ অঞ্চলে কিংবদন্তীর নেতা হিসাবে পরিচিত করে তোলে।তিনি হয়ে উঠেন সকলের প্রিয় “বাবুদা” হিসাবে।
কমরেড অমল সেন ১৯৩৫ সনে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন।
সমাজে জাতপাতের যে বিভাজন আর শ্রেণীশোষণ প্রত্যক্ষ করেছেন অমল সেন তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে নিজের অবস্থান দৃঢ় করতে হবে। শোষিত জনগণই পারে শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। নিজের পরিবার পরিজনের বিরুদ্ধে তাঁকে লড়াই করতে হবে সেটা তিনি বুঝে ফেলেছেন এবং ঐ বাড়ীতে থেকে সেটা সম্ভব না সেটাও তিনি বুঝে ফেলেছিলেন। “লাঙ্গল যার জমি তার” এই শ্লোগান নিয়ে অবশেষে বেরিয়ে পড়লেন বাড়ী ছেড়ে।
গৃহত্যাগ : ১৯৩৭ সালে তিনি নিজ পরিবার ত্যাগ করে শ্রেণীচ্যুত হয়ে বাকড়ীর ১১ খানের রসিকলাল ঘোষের বাড়ীতে চলে
আসেন। ঐ যে বেরিয়ে এলেন, আর কখনো অধিকার নিয়ে নিজের জমিদার বাড়ীতে ফিরে যাননি। তিনি হয়ে গেলেন সবর্হারা। মার্কসীয় ভাষায় যাকে বলে শ্রেনীচ্যুত।
অমল সেন যখন এগারোখান অঞ্চলে গেলেন তখন ঐ অঞ্চলের অবস্থা আদৌ ভালো ছিল না। লেখাপড়া, যোগাযোগ, চেতনা-উপলব্ধি, জীবনাচরণ বলতে গেলে কোনটাই ছিলনা। নিরন্ন খেটে খাওয়া মানুষগুলিকে জাতে তোলার জন্য কৃষক সংগ্রামের পাশাপাশি বাকড়ী হাই স্কুলে শিক্ষকতার কাজ শুরু করেন।
১৯৪২ সাল সারা ভারতবর্ষ জুড়ে এক অস্থির অবস্থা। শুরু হয় ২য় বিশ্বযুদ্ধ। খুলনা-বরিশাল-যশোর অঞ্চলকে নিয়ে গঠিত হয় গেরিলা টিম। কমরেড অমল সেন সে টিমের সদস্য হন। ঐ সময় একদিকে যুদ্ধের বিভিষিকা অন্যদিকে সাইক্লোন, ভারত ছাড়ো আন্দোলন, জাপানী বিমানের বোমাবর্ষণ, একের পর এক গণবিক্ষোভ, পুলিশের সাথে খন্ডযুদ্ধ, শ্রমিক আন্দোলন ও ধর্মঘট, কলকাতা দাঙ্গা, নোয়াখালি স্বাধীনতা, প্রাকৃতিক বন্যা- এসব কারনে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ, যার নাম দেয়া হয়েছিল মম্মন্তর। দুর্ভিক্ষের কারনে তখন সারা ভারত জুড়ে একটা হাহাকার অবস্থা শুরু হয়েছিল। হাজার হাজার মানুষ না খেয়ে মরতে বসেছিল। দুর্ভিক্ষ পিড়ীতদের সহায়তার জন্য সাহায্য সহযোগিতার আয়োজন করতে ত্রান কমিটি গঠন করতে হয়। অমল সেনের নেতৃত্বে বাড়ী-বাড়ী ঘুড়ে গান-বাজনা, নৃত্য-গীত করে টাকা-পয়সা সংগ্রহ করে আবার বাড়ী বাড়ী গিয়ে তা দুঃস্থদের মধ্যে বিলায়ে এ অঞ্চলের গরীব মানুষের পাশে দাড়িয়েছিলেন।
তেভাগা আন্দোলন ১৯৪৫-৪৬ : বৃটিশ শাসনামলে চিরস্থায়ী ভূমী বন্দোবস্তের ফলে ভারতবর্ষ জুড়ে যে ভূ-স্বামী গোষ্ঠীর জন্ম হয়েছিল তাদের বেশীর ভাগই ছিল নগরবাসী ও উচ্চবর্ণের হিন্দু। তারা তাদের জমিদারী থেকে ছিল বিচ্ছিন্ন তাই তাদের জমিজমা ব্যবস্থাপনা করতো তাদের নিয়োজিত স্থানীয় এজেন্টরা। জমির সঙ্গে এদের সাথে মূল সম্পর্ক ছিল ব্যবসাভিত্তিক। বৃটিশ শাসককে নির্ধারিত খাজনা দেওয়ার পর বর্গাদার থেকে আদায়কৃত খাজনার সম্পূর্ণ লভ্যাংশ তাদেরই থাকতো। এরা বন্দোবস্ত জমি খাজনা বা ভাগচাষের বিনিময়ে বন্দোবস্ত দিত কৃষকদের কছে। ভাগচাষী কৃষকরা ছিলেন মুসলমান এবং নমশুদ্র। ভাগচাষের সম্পর্ক বাদেও এদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল প্রজা-মনিবের । মুসলমান এবং নমশুদ্র কৃষকদের উপর বর্ণ হিন্দুদের অর্থনৈতিক শোষণ ছিলো তীব্র। কৃষকদেরকে অবজ্ঞা এবং তাচ্ছিল্য করতেন তারা।
জমির উপর কৃষকদের কোনরকম অধিকার ছিলনা, শুধুমাত্র ভাগচাষের বিনিময়ে উৎপাদিত ফসলের পঞ্চাশ ভাগ ফলন দিয়ে দিতে হতো ভূস্বামী বা জোতদারের হাতে। উৎপাদিত ফলনের অর্ধেক অথবা আধা দিয়ে দেয়ার কারনে একে বলা হতো আধি চাষ, আর যারা এ চাষের সাথে জড়িত তাদের বলা হতো আধিয়ার। এ প্রথা পশ্চিমবঙ্গে বর্গা, বীরভূমে কিসানী এবং ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা অঞ্চলে টংক নামে পরিচিত ছিল। বাংলার সর্বত্রই এ প্রথা প্রচলিত ছিল। আধি চাষ প্রথার ফলে ভূ-স্বামী আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হতে থাকলো আর কিছু কিছু বর্গা চাষী কোনরকম খেয়ে পড়ে বেঁচে বর্তে থাকলেও অধিকাংশ চাষীরা ক্রমান্বয়ে নিস্বঃ হতে শুরু করলো, অধিকাংশরা ঋনগ্রস্থ হয়ে পড়লো। খাজনা বাকী পড়ায় জোতদাররা অমানসিক অত্যাচার নির্য়াতন শুরু করলো। দিনে দিনে তাদের অত্যাচার নির্য়াতন বেড়ে চললো। এতে কৃষকদের মধ্যে ক্ষোভ দানা বাধতে শুরু করে। কৃষকদের মধ্যে শুরু হয় আন্দোলন। সে আন্দোলন আস্তে আস্তে চরম আকার ধারন করে যা তেভাগা আন্দোলন নামে পরিচিত।
১৯৪৬ সালের সেই ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন জন নেতৃত্ব দিলেও বৃহত্তর নড়াইল-যশোরে নেতৃত্ব দেন কমরেড অমল সেন।
তেভাগা আন্দোলনের ফসল ঘরে উঠতে না উঠতেই ১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতী তত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান দু-ভাগে ভাগ হয়ে যায়। দেশ বিভাগের পর থেকেই অমল সেনরা পাকিস্তানী মুসলিম লীগ সরকারের রোষানলে পড়েন। চলে যান আত্মগোপণে।
১৯৪৮ সনে কমরেড অমল সেন যশোর কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক নিযুক্ত হন। এ সময়ই কমরেড রনদীভের বাম হঠকারী “দালাল হালাল লাইন” প্রয়োগের ফলে নড়াইলের কৃষক এলাকাগুলোতে এবং পার্টির কর্মীদের ওপর বর্বরোচিত আক্রমণ শুরু হয়। ডুমুরতলার নুরুল হুদা, বড়ন্দারের শ্যামা কামার, বাকড়ীর পুলিনকে পাটির নির্দেশে হত্যা ও আহত করা হয়। কমরেড অমল সেন দালাল হালাল লাইনের (রনদীভের বাম হঠকারী লাইনের) বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। এ কারণে কলকাতা পার্টি কংগ্রেস থেকে ফিরে এসেই দেখতে পান যে, তাকে যশোর জেলা সম্পাদকের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
এসব কারনে ও তেভাগা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার অজুহাতে অমল সেন ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানী মুসলিম লীগ সরকারের রোষানলে পড়ে কারারুদ্ধ হয়ে যান এবং ১৯৫৬ সন পয়র্ন্ত জেলে আটক থাকেন।
১৯৫৬ সালের শেষভাগে মুক্ত হয়ে ১৯৫৮ পয়র্ন্ত দুবছর জেলের বাইরে থাকেন- এ দু বছর তিনি শিক্ষকতা পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। কারন ঐ সময় কৃষক পরিবারের ছেলেমেয়েদের মধ্যে শিক্ষার হার খুবই কম ছিলো। চাকুরিজীবির হারও অতি কম, নেই বললে চলে। জেল থেকে মুক্তি লাভের পর তিনি এই বিষয়ের উপর জোড় দিলেন যে, শিক্ষা ছাড়া জাতীর অগ্রগতি সম্ভব নয়, তাই তিনি শিক্ষকতা পেশায় আত্মনিয়োগ করলেন। তিনি বুঝতে পারলেন একজন আদর্শ শিক্ষক অনেকগুলো আদর্শ ছাত্র-ছাত্রী তৈরি করতে পারেন। তাই বিভিন্ন উদ্যেগের পাশাপাশি নিজেই বাকড়ী স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যেই শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি একজন আদর্শ শিক্ষক হয়ে ওঠেন।
১৯৫৮ সনে সামরিক আইন জারির পর তিনি পুণরায় গ্রেফতার হয়ে জেলে চলে যান এবং দীর্ঘ ১০ বৎসর একটানা কারা ভোগের পর ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি কারামুক্ত হন। মুক্তি পাওয়ার পরপরই তিনি পার্টির যশোর জেলা কমিটির সদস্য হিসেবে নড়াইল অঞ্চলের দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। তাই স্বৈরাচারী সরকার তাঁকে বেশীদিন বাইরে থাকতে দেয়নি। তিনি আবারও কারারদ্ধ হন। উনসত্তুররে গণঅভ্যুত্থানরে সময় কিছুদিনের জন্য মুক্তি লাভ করলও আবার তিনি গ্রফেতার হয়ে যান।
১৯৭১ এর মার্চ মাসে জনগণ জেল ভেঙ্গে তাকে মুক্ত করেন। দীর্ঘ্ ১৯ বছর জেল জীবন অতিবাহিত করে আজীবন বিপ্লবী, অকৃতদার, নিঃস্বার্থ বিপ্লবী এ নেতা মুক্ত হয়ে ভারতে চলে যান এবং বাম আন্দোলনের কর্মীদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করতে খোলা চিঠি দিয়ে আহ্বান জানান। এরপর ভারতে বসেই বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটি গড়ে তোলেন এবং মুক্তিযুদ্ধে সংগঠকের দ্বায়িত্ব পালন করেন।
স্বাধীনতার পর তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং ১৯৭২ সনে চীন-মস্কো ধারার বিপরীতে লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলেন এবং সাধারণ সম্পাদক হিসাবে নির্বাচিত হন।
রাজনৈতিক জীবনে তিনি তার সময়ে বাম-ডান বিচ্যুতির বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট কর্মীদের সমাজ বিপ্লবের দিশা দেখিয়েছেন। তিনি তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা ও দর্শনের ভিত থেকে কিছু মূল্যবান প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন- “জনগণের বিকল্প শক্তি” তার মধ্যে অন্যতম।
১৯৭৭ সনে প্রকাশ করেন ”কমিউনিস্ট বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সমস্যা প্রসঙ্গে” নামক প্রবন্ধটি। এরপর কমিউনিস্ট পার্টি এবং জীবনবোধের অনুশীলনে ”কমিউনিস্ট জীবন ও আচরণ রীতি প্রসঙ্গে”। তেভাগা আন্দোলন নিয়ে ”নড়াইল তেভাগা আন্দোলনের সমীক্ষা” নামক একটি অতি মূল্যবান প্রবন্ধ রচনা করেন।
১৯৮০ সালে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (লেনিনবাদী) বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি নাম ধারণ করে এবং তিনি ওয়ার্কার্স পার্টির মহাসচিব নির্বাচিত হন ।
১৯৮৮ সালে ৬ পার্টির সমন্বয়ে গড়ে ওঠে ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ। কমরেড সেন এ পার্টির কে›ন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৯২ সালে ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, সাম্যবাদী দল ও ওয়ার্কার্স পার্টি ঐক্যবদ্ধ হয়ে গঠিত হয় ”বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পাটি”। কমরেড অমল সেন ঐক্যবদ্ধ ওয়ার্কার্স পাটির্ সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯৯৫ সালের পার্টি কংগ্রেসে তিনি পুনরায় ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি নির্বাচিত হন।
তাঁর জীবিতাবস্থায় সর্বশেষ ২০০০ সালে অনুষ্ঠিত পার্টি কংগ্রেসে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন।
নিঃস্বার্থবাদী, আজীবন কমিউনিস্ট বিপ্লবী এই নেতা ২০০৩ সনের ১৭ জানুয়ারী (৪ মাঘ ১৪০৯ বাংলা) ৮৯ বছর বয়সে ঢাকার কমিউনিটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
কমরেড অমল সেন আজীবন যে গ্রামের মাটি ও মানুষের জন্য সংগ্রাম করেছিলেন সে গ্রামের বাকড়ী স্কুল প্রাঙ্গনে তাকে চির-সমাহিত করা হয়।
কমরেড অমল সেনের জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে এদেশের বিপ্লবী আন্দোলনকে আরো এগিয়ে নিতে হবে। কমরেড অমল সেন লাল সালাম।
জসিম উদ্দিন
এভিপি ডিজাইন
এটিএন বাংলা
১৭ জানুয়ারী ২০১৬