নাদিম আহমেদ অনিক, স্টাফ রিপোর্টার:
কালের বিবর্তনে আগুন ঝরা ফাগুনে চোখ ধাঁধানো গাঢ় লাল রঙের ফুলে অপরূপ সাজে সজ্জিত শিমুল গাছ এখন বিলুপ্তপ্রায়। ঋতুরাজ বসন্তের উপস্থিতিতে আবহমান গ্রামবাংলার প্রকৃতিকে রাঙিয়ে অনেক ফুল ফোটলেও এখন আর তেমন চোখে পড়েনা রক্তলাল নয়নাভিরাম শিমুল ফুল। বিগত এক-দেড় যুগ আগেও বিভিন্ন গ্রামের অধিকাংশ বাড়ির আনাচে কানাচে আর রাস্তার পাশে অনেক শিমুল গাছ দেখা যেতো। প্রতিটি গাছে গাছে প্রস্ফুটিত শিমুল ফুলই স্মরণ করিয়ে দিতো বসন্ত। শীতের পরেই ঋতুরাজ বসন্তের আগমনের সাথে সাথে প্রকৃতিতে লেগেছে তার ছোঁয়া। প্রতিতি গাছেই আসতে শুরু করেছে নতুন পাতা।
প্রকৃতিতে দক্ষিণা বাতাসে আমের মুকুলের মৌ মৌ ঘ্রাণে মুগ্ধ চারিদিক আর কোকিলের সুমিষ্ট কুহুতালে ফাগুনের উত্তাল বাসন্তি হাওয়া দিচ্ছে দোলা। গাছে গাছে জেগে উঠেছে সবুজ পাতা। মুকুল আর শিমুল ফুল দেখে বোঝা যায় শীত বিদায় নিয়ে এসেছে ফাগুন। শিমুল গাছের শাখাগুলো বসন্তের আগমনে লাল শাড়ির ঘোমটা পরা গ্রাম্য নববধূর সাজে সজ্জিত হতে দেখা যায়, যা দর্শনে হতাশ প্রেমিকের মনেও জাগিয়ে তোলে আশা। অন্যান্য গাছের তুলনায় শিমুল গাছ অনেক উঁচু হওয়ায় বহু দূর থেকে এ মনোরম দৃশ্য চোখে পড়ে। জোয়ার এনে দেয় কবির কল্পনার জগতে। কেবল সৌন্দর্যই বিলায় না শিমুল গাছের রয়েছে নানা উপকারিতা ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব। জানা যায়, প্রাকৃতিক ভাবে তুলা আহরণের অন্যতম অবলম্বন শিমুল গাছ।
এ গাছের সব অংশেরই রয়েছে ভেষজগুণ। আয়ুবৈদিক চিকিৎসকরা এখনো নানা রোগের চিকিৎসায় এ গাছের বিভিন্ন অংশ ব্যবহার করে। শিমুল গাছের বৈজ্ঞানিক নাম “বোমবাক্স সাইবা লিন”। এটি বোমবাকাসিয়াক পরিবারের উদ্ভিদ। বীজ ও কান্ডের মাধ্যমে এর বংশবিস্তার হয়। রোপণের ৫-৬ বছরের মধ্যে শিমুল গাছে ফুল ফোটে। ৯০ থেকে ১০০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। সেই তুলনায় বেশ মোটাও হয় । নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে শিমুল গাছ দেড়শ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। শীতের শেষে পাতা ঝরে পড়ে। বসন্তের শুরুতেই গাছে ফুল ফোটে। আর এ ফুল থেকেই হয় ফল। চৈত্র মাসের শেষের দিকে ফল পুষ্ট হয়। বৈশাখ মাসের দিকে ফলগুলো পেকে শুকিয়ে গিয়ে বাতাসে আপনা আপনিই ফল ফেটে প্রাকৃতিকভাবে তুলার সাথে উড়ে উড়ে দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়া বীজ থেকেই এর জন্ম হয়। অন্যান্য গাছের মত এ গাছ কেউ শখ করে লাগায় না।
নেওয়া হয়না কোন যতœ। অযতœআর অনাদরে প্রাকৃতিকভাবেই গাছ বেড়ে ওঠে। এ গাছের প্রায় সব অংশই কাজে লাগে। এর ছাল, পাতা ও ফুল গবাদিপশুর খুব প্রিয় খাদ্য। বালিশ, লেপ ও তোষক তৈরিতে শিমুল তুলার জুড়ি নেই। অথচ বর্তমানে মানুষ এ গাছকে তুচ্ছ মনে করে কারণে অকারণে কেটে ফেলছে। অতীতে ব্যাপকহারে নির্মাণ কাজ, টুথপিকসহ নানা ধরনের প্যাকিং বাক্স তৈরি ও ইটভাটার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হলেও সেই তুলনায় রোপণ করা হয়নি। ফলে আজ বিলুপ্তির পথে।
শিমুল গাছ উজাড় হওয়ার ফলে পরিবেশের উপরে পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। এ গাছ অনেক উঁচু হওয়ায় কাক, কোকিল, চিল, বকসহ বিভিন্ন ধরনের পাখি বাসা বেঁধে বসবাস করত। এ গাছ উজাড় হওয়ার ফলে এসব পাখিরা আবাসস্থল হারিয়ে পড়েছে অস্তিত্ব সংকটে। গাছ না থাকায় আবাসস্থলের অভাবে ধীরে ধীরে এসব পাখিরাও হারিয়ে যাচ্ছে। নওগাঁ সদর উপজেলার দুবলহাটি ইউনিয়নের বাসিন্দা মোঃ সাইদুর রহমান বলেন, শিমুল গাছ আর খুব একটা চোখে পরেনা, কয়েক বছর আগেই রাস্তার মোড়ে মোড়ে দেখা যেত,আর বসন্তের শুরুতে চোখে পরত লাল টুকটুকে ফুল। তবে সবই হারিয়ে যেতে বসেছে সময়ের পরিক্রমায়।
জেলার আত্রাই উপজেলার ভবানীপুর গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি আব্দুল আজিজ বলেন, আগে গ্রামে প্রচুর শিমুল গাছ ছিল। এই শিমুল ঔষধি গাছ হিসেবেও পরিচিত। গ্রামাঞ্চলের মানুষ বিষফোঁড়া ও কোষ্ঠকাঠিন্য নিরাময়ে এ গাছের মূল ব্যবহার করত। একই গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘একটি বড় ধরনের গাছ থেকে তুলা বিক্রি করে ১০-১৫ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব।
আগের তুলনায় এখন শিমুলের তুলার দাম অনেক বেড়ে গেছে। এর পরও এই গাছ নিধন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এ বিষয়ে দৈনিক খবর বাংলাদেশ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক জাকির হোসেন মোল্যা বলেন, শিমুল গাছ রক্ষায় এখনই ব্যবস্থা না নিলে এক সময় উপকারী গাছের তালিকা থেকে এ গাছটি হারিয়ে যাবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো জানতেও পারবে না বাংলার মাটিতে শিমুল নামের কোন গাছ ছিল।