ওবায়দুর রহমান, গৌরীপুর (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধিঃ
আমার মেয়েকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাহার গলা কাটা, হাতের আঙুল কাটা। তাকে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে। আমার মেয়েতো কোনো দোষ করে নাই, তাকে কেন মেরে ফেললো। মেয়ের হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই।
বুধবার (৩০ অক্টোবর) শ্রীপুর থানার সামনে মেয়ের হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিতে অভিযোগ দায়ের করতে এসে থানার সামনে কথাগুলো বলে বারবার মোর্ছা যাচ্ছিলেন ময়মনসিংহের গৌরীপুরের দৌলতপুর গ্রামের সুনীল চন্দ্র পাল।
তিনি জানান, তার মেয়ে স্মৃতি রানী পাল (২৪) কে গাজীপুরের শ্রীপুরের বরমী কামারপাড়া এলাকায় সোমবার (২৮ অক্টোবর) রাতে পরিকল্পিতভাবে কুপিয়ে-জবাই করে হত্যা করা হয়েছে।
বাসায় গিয়ে দেখা যায়, আরেক হৃদয় বিদারক দৃশ্য, সন্তানকে হারিয়ে বারবার সংজ্ঞাহীন হয়ে যান তার মা ঊষা রাণী পাল। তিনি বারবার বকে যাচ্ছেন আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দাও, তোমরা স্মৃতিকে কোথায় রেখেছো তাকে এনে দাও, আমার বুকে এনে দাও। মায়ের এমন আহজারীতে কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলো না।
এ ঘটনায় শ্রীপুর থানায় নিহতের বাবা সুনীল চন্দ্র পাল বাদী হয়ে বুধবার (৩০ অক্টোবর) মামলা দায়ের করেন। ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে নিহতের স্বামী কাব্য সরকার (২৬), তার মামা নিমাই সন্নাসী (৫৫) ও মামী বেলী সরকার (৪০) কে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
মামলা ও গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করেন শ্রীপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (অপারেশন) নয়ন কর।
তিনি জানান, গ্রেফতারকৃত আসামীদের ৫দিনের রিমাণ্ড চেয়ে বিজ্ঞ আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে।
নিহতের পরিবার সূত্রে জানায়, প্রায় ৩বছর পূর্বে শ্রীপুরের কেওয়াপশ্চিমখন্ডের বাসিন্দা কেসব সরকারের পুত্র কাব্য সরকারের সঙ্গে স্মৃতি রাণী পালের বিবাহ হয়। দাম্পত্য জীবনে দেড় বছরের সিয়াম নামের একটি শিশু সন্তান রয়েছে।
সোমবার রাত ৯টা ৩০মিনিটে তার মেয়ে তাকে ফোনে জানায়, কালিপূজার জন্য মেয়ের জামাতা কাব্য সরকার রাত সাড়ে ৮টায় ভারতের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে রওয়ানা হয়েছে। নাতি সিয়ামকে নিয়ে তার মেয়ে শুয়ে আছে।
পরে রাত ১০টার দিকে কাব্য সরকার ফোনে তার শ্বশুড়কে জানায় যে, স্মৃতি পালের কি যেনো হয়েছে শ্রীপুর হাসপাতালে যেতে। সেখানে তার বাবা গিয়ে দেখতে পান মেয়ের গলাকাটা নিথর দেহ হাসপাতালের বেডে পড়ে আছে। ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলা কাটা, ডান হাতের আঙ্গুলের মাঝামাঝি গভীর কাটা জখম রয়েছে।
প্রতিবেশী ও বাড়ির লোকজন জানায়, সোমবার সন্ধ্যা ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে স্মৃতির স্বামী কাব্য ভারতের উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হন। আর বাড়ির দক্ষিণ ভিটির ঘরে কাব্যের নানি ও মামি ঘুমিয়ে ছিলেন। পাশের কক্ষে ঘুমিয়ে ছিলেন মানসিক ভারসাম্যহীন মামা। মামাতো বোন অপস্বরা পড়ছিল পাশের ঘরে। হঠাৎ স্মৃতির চিৎকার শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন তারা। পরে তাদের চিৎকার শুনে ছুটে আসে বাজারের লোকজন। এ সময় স্মৃতিকে রক্তাক্ত অবস্থায় বারান্দায় পড়ে থাকতে দেখেন তারা।
এ ঘটনায় উপজেলা পূজা উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুমন জানান, রাত আনুমান সাড়ে ৯টার দিকে ওই বাড়িতে হঠাৎ চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে বাড়ির ভেতর যাই। বারান্দায় স্মৃতিকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখি। তাকে উদ্ধার করে প্রথমে বরমী বাজারের একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য শ্রীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাই। কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. সুদেব চক্রবর্তী জানান, রাত ১০টা ৪০ মিনিটের সময় স্মৃতিকে হাসপাতালে আনা হয়। এর আগেই তার মৃত্যু হয়। নিহতের ঘাড়ে ধারালো অস্ত্রের কোপের চিহ্ন রয়েছে। এ ছাড়া ডান হাতের কব্জির কাছাকাছি পর্যন্ত কাটা ছিল। খবর দিলে পুলিশ এসে মরদেহ উদ্ধার করে।
শ্রীপুর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. জয়নাল আবেদীন মন্ডল সাংবাদিকদের জানান, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ওই নারীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে একটি রক্তমাখা ধারালো নতুন দা, এক জোড়া সেন্ডেল উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে কাজ করছে পুলিশ।