মনসুর আহমেদ, হবিগঞ্জ
নিয়তি বড়ই নির্মম। দেশ স্বাধীনতা অর্জনের ৫১বছর চলে গেলেও চুনারুঘাটের রানীর কোট (কিরতাই) গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ রইছ উল্লাহ’র নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি। শুধু মাত্র তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে স্থানীয়ভাবে একটি মুক্তমঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। তাঁর স্ত্রী সন্তানদেরও কেউ কোন খুঁজ খবরও রাখেনি। এনিয়ে তাদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। শহীদ রইছ উল্লাহর বৃদ্ধা স্ত্রী ফাতেমা খাতুন তাঁর স্বামীর শহীদী তালিকায় নাম দেখে যেতে চান।
তৎকালীন হবিগঞ্জ মহকুমার চুনারুঘাট থানা। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ৭মার্চের ভাষনের পর সারা দেশের মত ভারতীয় সীমান্ত থানা চুনারুঘাটে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়। রাজার বাজার সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে রাজার বাজার ব্যবসায়ী সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ও বস্ত্র ব্যবসায়ী আওয়ামীলীগ নেতা রইছ উল্লাহর স্বউদ্যোগে এলাকার ছাত্র যুবক, কৃষকদের সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু করেন। এ সময় রাজার বাজার এলাকার আরো বিশিষ্ট জনেরা রইছ উল্লাহ’র সাথে জড়িত হোন। তৎকালীন ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ (ক্যাপ্টেন অবঃ) মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ প্রশিক্ষণ প্রদান করতেন।
৩০ এপ্রিল ১৯৭১ সালে স্থানীয় দালালদের ইশারায় মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক রইছ উল্লাহকে পশ্চিম রানীর কোট (কিরতাই) গ্রাম থেকে ভোরবেলা তুলে নিয়ে যায়। চুনারুঘাট সিও অফিসে ছিল পাক হায়েনাদের ক্যাম্প। ওই ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিল পাকিস্তানি জল্লাদ নামে খ্যাত ক্যাপ্টেন ইউসুফ খান। সে রইছ উল্লাহকে পেয়ে উগ্রমুর্তি ধারণ করে নির্মমভাবে হত্যা করে বলে জানা যায়। রইছ উল্লাহর বড়ভাই স্কুল শিক্ষক ইউসুফ উল্লাহ সহ স্বজন প্রতিবেশীরা অনেক খুঁজাখুঁজি তাঁর মরদেহ পাননি। এ সময় শহীদ রইছ উল্লার ৩ ছেলে ও ১ মেয়েরা ছিলো ছোট।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ফয়জুল ইসলাম তালুকদার বলেন, শহীদ রইছ উল্লাহ মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে রাজার বাজার স্কুলে আমাদেরকে ট্রেনিং করাতেন। পাকিস্তান বাহিনী পাল বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে উনাকে বাড়ী থেকে তুলে নিয়ে নির্মম ভাবে হত্যা করে। তাঁর স্মৃতি রক্ষায় ব্রাদার্স ক্লাব ও আমার প্রচেষ্টায় প্রায় একযুগ আগে রাজার বাজারে শহীদ রইছ উল্লাহর নামে মুক্তমঞ্চ নির্মাণ করি। আমি শহীদি তালিকায় তাঁঁর নাম অন্তর্ভুক্তীর জোর দাবি জানাচ্ছি।”
বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহমান আজাদ বলেন, “শহীদ রইছ উল্লাহ আমুরোড ও রাজার বাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের সুসংগঠিত করতে তৎকালীন সময়ে মুক্তি সংগ্রাম পরিষদে নেতৃত্ব দিয়েছেন। পাল বাড়ীর হত্যাযজ্ঞের সময় তাকেও বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়। আমি তাঁর শহীদি মর্যাদার জোর দাবি জানাচ্ছি”।
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চুনারুঘাট উপজেলা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার আব্দুল গাফফার বলেন, “শহীদ রইছ উল্লাহ চুনারুঘাটের দক্ষিনাঞ্চলের সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম একজন নেতা ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে প্রায় ৯০ মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ নিয়ে ভারতে বিভিন্ন সেক্টরে যুদ্ধে অংশ নেয়। এছাড়া তেলিয়াপাড়া অস্থায়ী সদর দপ্তরে খাদ্য সামগ্রী নিয়মিত সরবরাহ করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পর তিনি ভারতে না গিয়ে যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণ সহ মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগিতা করার লক্ষে দেশেই থেকে যান এবং পাকবাহিনীর হাতে নির্মম ভাবে মৃত্যুবরণ করেন। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে শহীদ রইছ উল্লাহকে শহীদ এবং তার পরিবারকে শহীদ পরিবার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার আহবান জানাই।”
শহীদ রইছ উল্লাহ’র ছোট ছেলে আব্দুল গফুর ওরফে আলফু মিয়া বলেন, “জন্মের পর যখন বড় হয়েছি, তখনই মায়ের অশ্রুভেজা চোখ আর অসহাত্ব দেখে আসছি। যা আমাদের ভাইবোনদের মাঝে মায়ের এক নিঃশব্দ নির্বাক কান্নাই আমাদের জীবনের সুখ আহ্লাদ যেন ধূলোয় মিশে আছে। আমাদের মা ভাইবোনেরা কি জানতাম আমাদের জীবনে বাবার অনুপস্থিতি কি যে বেদনাবিধুর তা এখন প্রতিটি মুহুর্তে শুধুই ভাবায়। তার পরও যদি আমাদের বৃদ্ধা মা শহীদি তালিকায় আমার বাবার নাম জীবিতকালীন দেখে যেতে পারতেন, তাহলে সারা জীবনের ব্যাথাবেদনা কিছুটা হলেও লাগব হতো।”