বাংলাদেশ ১১:১৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
নোটিশ :

সাংবাদিক নিয়োগ চলছে,, সাংবাদিক নিয়োগ চলছে,,০১৯৯৯-৯৫৩৯৭০, ০১৭১২-৪৪৬৩০৬,০১৭১১-০০৬২১৪ সম্পাদক

     
ব্রেকিং নিউজ ::
টানা ৬ ঘণ্টা বৃস্টিতে পিরোজপুরবাসীর প্রাণে বইছে স্বস্তি ঠাকুরগাঁওয়ের আরেক মাফিয়া -৪ পর্ব ।। আলাদিনের চেরাগ পাওয়া বালিয়াডাঙ্গীর বেলাল দুদকের নজদারীতে তানোরে নির্বাচন ঘিরে পুলিশ প্রশাসনের কড়া নিরাপত্তা ভোট কেন্দ্র পরিদর্শনে ডিসি”এসপি কালকিনিতে বজ্রপাতে প্রতিবন্ধীর মৃত্যু বিয়ানীবাজার উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পদক বহিষ্কার মুলাদী উপজেলায় হুমায়ুন কবির শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত রাবিতে হলরুমে আটকে তিনঘণ্টা যাবৎ নির্যাতনের অভিযোগ ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে পথের ধারে সৌন্দর্যের ডালি সাজিয়ে বসেছে লাল টুকটুকে কৃষ্ণচূড়া তানোরে রাত পোহালেই ভোট গ্রহন’ কঠোর নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা পুরো এলাকা কাউখালীতে বাড়ছে অপমৃত্যুর প্রবণতা।  ভান্ডারিয়ার কৃতি সন্তান আকাশ ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সমাজসেবা সম্পাদক রাজশাহীতে সাড়ে ৩ কোটি টাকার হেরোইনসহ মাদক কারবারীকে গ্রেফতার ২ রাজশাহী নগরীতে তরুণী ধর্ষণ মামলার আসামী গ্রেফতার পানি সংকটে মারা যাচ্ছে রুয়েটে সৌন্দর্য বর্ধনের ফুলগাছ, অভিযোগ পথচারীদের কৃষকদেরকে আধুনিক প্রযুক্তির সাথে অভ্যস্ত হতে হবে

মাধ্যমিক শিক্ষা, শিক্ষকের উন্নয়ন ও নতুন কারিকুলাম!

  • নিজস্ব সংবাদ :
  • আপডেট সময় ১২:৪২:৩৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ১০ জানুয়ারী ২০২৪
  • ১৮২৮ বার পড়া হয়েছে

মাধ্যমিক শিক্ষা, শিক্ষকের উন্নয়ন ও নতুন কারিকুলাম!

 

 

 

মাধ্যমিক শিক্ষা, শিক্ষকের উন্নয়ন ও নতুন কারিকুলাম!
আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখন পর্যন্ত সেই ঔপনিবেশিক বৃত্তেই রয়ে গেছে! ফলে আমরা শিক্ষাকে এখন পর্যন্ত কাঙ্খিতমানে পৌঁছাতে পারিনি। বিশেষ করে দেশের মাধ্যমিক শিক্ষা এখনো অনেকটাই পশ্চাৎপদ রয়ে গেছে। পৃথিবীর অধিকাংশ রাষ্ট্রগুলো তাদের মাধ্যমিক শিক্ষাকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে, যদিও আমাদের দেশে এখনও এই সেক্টরটি অবহেলিতই রয়ে গেছে। সরাসরি যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে উচ্চ শিক্ষার ওপর।
যেকোনো দেশের শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় হচ্ছে মাধ্যমিক শিক্ষাস্তর। প্রাথমিক ও উচ্চ শিক্ষাস্তরের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে মাধ্যমিক শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। এই শিক্ষাস্তরে অর্জিত জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গিই একজন শিক্ষার্থীকে ভবিষ্যতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ এবং দেশ ও জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সহায়তা করে।
অথচ আমাদের দেশে মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরটি সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত এবং বঞ্চিত! এটা সকলের জানা যে, এই সেক্টরে যোগদানকারী একজন শিক্ষককে তার যোগদানকালীন পদে থেকেই অবসরে যেতে হয়! পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এমন ঘটনার নজির নেই! তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবং সাবেক আমলা ডঃ আকবর আলী খান বেশ কয়েক বছর আগে একটি সেমিনারে বলেছিলেন- একজন চাকরিজীবীর সবচেয়ে বড় একটি অধিকারের বিষয় হলো কর্মকালীন সময়ে তার প্রমোশন বা পদোন্নতি। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত দক্ষতা অর্জন সাপেক্ষে একজন কর্মচারীর জন্য পদোন্নতি পাওয়া তার অধিকারের মধ্যে পড়ে। অথচ দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো আমাদের দেশের মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরে হাজারো শিক্ষক একই পদে যোগদান করে দীর্ঘ ৩০-৩২ বছর পর্যন্ত শিক্ষকতার মহান পেশায় নিজেকে উৎসর্গ করেও একই “সহকারী শিক্ষক” পদে থেকেই অবসরে গিয়েছেন!
এ দেশের বুদ্ধিজীবী, আমলা, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ চান যে শিক্ষার মান উন্নয়ন হোক। এখন বলুন তো শিক্ষকের মান উন্নয়ন নিয়ে আপনারা নীরব কেন? কোনো জাতির শিক্ষার বাহক হল শিক্ষক। শিক্ষক যদি ভালো না থাকেন, তবে জাতির জন্য উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা কিভাবে তারা বহন করবেন এবং বিস্তার ঘটাবেন; দয়া করে বলবেন কি? আসলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় এদেশের বড় বড় কর্তা ব্যক্তিরা বা রাষ্ট্রের কর্ণধারগণ বোধহয় মাধ্যমিক স্তর বাদ দিয়েই শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করেছিলেন! তা না হলে তাদের জীবনের গঠনকালীন সময়ের সম্মানিত শিক্ষকদের পেশাটিকে আকর্ষণীয় এবং সামাজিকভাবে মর্যাদার আসনে আসীন করতে তারা কেন কোনো ভূমিকা রাখছেন না?
আমাদের জাতীয় বাজেটে শিক্ষা ক্ষেত্রে বাজেট অপ্রতুল। সামগ্ৰিক শিক্ষার পাশাপাশি মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। শুধু ভবন নির্মাণের জন্য উন্নয়ন ব্যয় কেন? শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষকদের মানসম্মত বেতন দেওয়ার জন্য বাজেটে বরাদ্দের উদ্যোগ কেন নেওয়া হয় না? আজকে একজন শিক্ষক যদি ভালো থাকেন শিক্ষার বাহক হিসেবে শিক্ষার্থীদের উন্নত ও মানসম্মত শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের আন্তরিকতা স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে।
বাংলাদেশে একজন শিক্ষকের যে বেতন-ভাতা এমন নিম্ন বেতন পৃথিবীর আর কোনো দেশের শিক্ষককে দেওয়া হয় বলে আমার জানা নেই! এর ফল হিসেবে আমরা যা দেখতে পাচ্ছি তার একটি উদাহরণ আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করছি: সুলেখক, সুবক্তা ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার তার স্মৃতিচারণ মূলক একটি গ্রন্থে লিখেছেন- একদিন তিনি ছাত্রদের জিজ্ঞেস করেন- তোমরা কে কে শিক্ষক হতে চাও? কিন্তু দুর্ভাগ্য! একজন শিক্ষার্থী ও সেদিন শিক্ষক হওয়ার জন্য হাত তুলেনি! কি বুঝলেন? শিক্ষকতার মত গুরুত্বপূর্ণ এই মহান পেশাটিকে আকর্ষণীয় এবং সামাজিকভাবে মর্যাদার উচ্চ আসনে নিতে না পারার কারণে আজ আমাদের সামনে এই চিত্রটা ধরা পড়লো!
আর যদি একজন শিক্ষককে উচ্চ বেতন এবং উন্নততর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জাতি গঠনের কারিগর হিসেবে গড়ে তোলা যেতো, একজন শিক্ষক যদি সামাজিকভাবে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত থাকতেন; তবে স্যারের শিক্ষার্থীরা নিশ্চয়ই সেদিন শিক্ষক হওয়ার জন্য হাত তোলার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতো! তাই নয় কি? সামাজিক মর্যাদা এবং আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে শিক্ষকদের যদি এভাবে সমাজের অবহেলিত অংশ হিসেবে ফেলে রাখা হয়, তবে আগামী প্রজন্ম মেধাবী শিক্ষকদের সংস্পর্শ থেকে বঞ্চিত হবে। আর এর ফলে তুলনামূলক দুর্বল ও কম মেধাবী শিক্ষকদের কাছে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কি শিক্ষা লাভ করবে-এ বিষয়টি আমাদের কর্তা ব্যক্তিরা ও রাষ্ট্রপরিচালকগণ ভেবে দেখেছেন কি?
আমাদের দেশে ছাত্র শিক্ষক অনুপাতের বিশাল চ্যালেঞ্জ, প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষক নিয়োগ, দুর্বল পরিদর্শন ব্যবস্থা, বিভিন্ন মানদন্ডে ও তথ্যউপাত্তের প্রেক্ষিতে সর্বজন স্বীকৃত দুর্নীতির শীর্ষে থাকা শিক্ষা প্রশাসন এবং অবৈজ্ঞানিক মনিটরিং ও দুর্বল পরিদর্শন ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা! তথাপিও আমাদের সম্মানিত শিক্ষকদের আন্তরিকতা এবং জাতির প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে তাঁরা নিরলস পরিশ্রম করে আমাদেরই সন্তানদের আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখে চলেছেন। উপরোক্ত চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখেও তাঁদের যে অবদান তার জন্য বাংলাদেশের সকল পর্যায়ের বিশেষ করে মাধ্যমিক স্তরের অবহেলিত শিক্ষকদেরকে জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।
দেশের মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশের বেশি মানুষের বসবাস গ্রামাঞ্চলে। আর গ্রামাঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষই দরিদ্র ও অশিক্ষিত। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে শিক্ষার হার বাড়াতে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতায় নানা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও প্রতিকূলতার ফাঁদে পড়ে গ্রামাঞ্চলে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা বেহাল দশায় পরিণত হয়েছে। সরকারি আইন অমান্য ও সংশ্লিষ্টদের লাগামহীন দুর্নীতির কারণে প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে মেধাহীন হয়ে পড়ছে এসব শিক্ষার্থী। ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের চিন্তায় হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে অভিভাবক মহল।
নানাবিধ অনিয়মের ফলে দীর্ঘদিনের পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হারাচ্ছে স্ব স্ব ঐতিহ্য। শহরাঞ্চলের মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার মান তুলনামূলক ভাবে ভালো থাকলেও তা এখনো বৈশি^ক মানে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। আর এক্ষেত্রে সরকারের বাজেট বরাদ্দে অপ্রতুলতাও অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যখন মাধ্যমিক শিক্ষাকে এগিয়ে নেয়ার জন্য বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখছে, তখন এক্ষেত্রে আমরা সেকেলে বৃত্তেই রয়ে গেছি।
গ্লোবাল পার্টনারশিপের এক বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশে মাথাপিছু জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) বিপরীতে মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয়ের পরিমাণ ১০ দশমিক ২ শতাংশ, যেখানে ভারতে এ হার ১৬ দশমিক ৮২ শতাংশ। পাকিস্তান মাথাপিছু জিডিপির বিপরীতে মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় করে ১৫ দশমিক ২২ শতাংশ। এ ছাড়া মালয়েশিয়ায় মাথাপিছু জিডিপির ২২ দশমিক ৯৭ এবং সিঙ্গাপুর ২২ দশমিক ২২ শতাংশ ব্যয় করে। ইউনেস্কো ইনস্টিটিউট অব স্ট্যাটিসটিকসের (ইউআইএস) তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে ‘এডুকেশন সেক্টর অ্যানালাইসিস (ইএসএ) ফর বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরেছে গ্লোবাল পার্টনারশিপ। পাঁচটি দেশের তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায়, মাথাপিছু জিডিপির বিপরীতে মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয়ে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।
একথা ঠিক যে, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপক প্রসার হয়েছে। তবে তা পরিকল্পিত উপায়ে ঘটেনি। বিশেষ করে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষায় এ সংকট বেশ প্রকট। গত পাঁচ দশকে দেশে হাজার হাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়া হয়েছে, যার প্রায় সবই বেসরকারি। আর মাধ্যমিক বিদালয়ের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেলেও শিক্ষার যথাযথ মাননিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি।
মূলত, শিক্ষার মাধ্যমিক স্তর হচ্ছে গোটা শিক্ষাব্যবস্থার মেরুদন্ড। বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় পরিচালনার জন্য রয়েছে একটি স্থানীয় কমিটি, যা ‘স্কুল ম্যানেজিং কমিটি’ নামে পরিচিত। শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় প্রতিনিধির সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে শিক্ষাকে ‘সাসটেইনেবল’ করা ও মান উন্নীত করার জন্য এ ব্যবস্থা। কিন্তু এ ব্যবস্থাই মাধ্যমিক শিক্ষার মানকে তলানিতে নিয়ে গেছে। যা অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত।
নানাবিধ কারণেই আমাদের দেশের মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থা স্থবির হয়ে পড়েছে। অপরাজনীতি ও আর অযোগ্যদের দৌরাত্ম্য এর অন্যতম কারণ হিসাবে বিবেচনা করছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। আবার অন্যদিকে রয়েছে শিক্ষকদের অপ্রতুলতাও। অনেক প্রতিষ্ঠানেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক নেই। নাজুক অবস্থানে থাকছে অবকাঠামো। যদিও বর্তমান সরকারের আমলে অবকাঠামগত উন্নয়নে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহ যথেষ্ট এগিয়েছে। তবে কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়াই উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করছেন। ফলে মানসম্পন্ন পাঠদান ব্যহত হচ্ছে।
এ ছাড়া শিক্ষার ব্যয় বেশি হওয়ায় স্বল্প আয়ের পরিবারের অনেক শিক্ষার্থীই মাধ্যমিকে এসে ঝরে পড়ছে। গত কয়েক বছরে কিছুসংখ্যক প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হলেও ঢাকা মহানগর খুলনা সিলেট ও বরিশাল মহানগর ব্যতীত মোটাদাগে দেশের অন্য কোন মহানগর জেলা শহরে সরকারি উদ্যোগে ভালোমানের মাধ্যমিক বিদ্যালয় গড়ে ওঠেনি। তাই স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরও মাধ্যমিক শিক্ষার ভিত অনেকটাই দুর্বল।
শিক্ষার মান এখন ধরা হয়, কতজন শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে; তাদের মধ্যে কতজন পাস করেছে! একটু ভালো বিদ্যালয় হলে বলা হয়, কতজন জিপিএ-৫ পেয়েছে। যেখানে শিক্ষাদান ও পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় সমস্যা থেকে গেছে, সেখানে একটি পাবলিক পরীক্ষার মূল্যায়ন যে শিক্ষার মানের কথা বলে না, সেটি বোধ হয় আর ব্যাখ্যা করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। পাবলিক পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নের যে পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, তাতে শিক্ষার্থীরা খাতায় যাই লিখুক; ফেল করার করার সুযোগই থাকে না। ফলে আমাদের মাধ্যমিক শিক্ষা মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি।
এসব সত্ত্বেও সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের কিছু নামকরা মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে, যে গুলোতে পড়াশোনা করলে বিদ্যালয়গুলোর নিজস্ব ব্যবস্থাপনা, কালচার, ট্র্যাডিশন, পদ্ধতি এবং শিক্ষকদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে শিক্ষার্থীরা বেসিক কিছু জ্ঞান অর্জন করে, বাস্তবধর্মী কিছু দক্ষতা অর্জন করে, যা সাধারণত প্রচলিত বিদ্যালয় ব্যবস্থায় হয় না। আর এসুযোগটা বিশেষ শ্রেণির জন্য ও সীমিত পরিসরের।
মূলত, প্রয়োজনীয় জমি ও সঠিক পরিকল্পনার অভাব আর ব্যবসায়িক মনোভাবের কারণেই আমাদের দেশের মাধ্যমিক শিক্ষা এখনও মানহীনই রয়ে গেছে । ভালো মানের বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার জন্য নেই কোনো সরকারি উদ্যোগ, নেই ব্যক্তি বা সামাজিক উদ্যোগ। ফলে দেশে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়লেও লক্ষ্য অর্জনে তেমন একটা সহায়ক হচ্ছে না।
বস্তুত, মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষায় দুর্বলতা থেকে গেলে গোটা ব্যবস্থার ভিতই নড়বড়ে হয়ে পড়ে। আর এটিই আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। সঠিক পরিকল্পনার অভাবে অনেকটা বিচ্ছিন্নভাবে পরিচালিত হচ্ছে মাধ্যমিকের প্রতিষ্ঠান। নানা ক্যাটাগরিতে বিভক্ত বিদ্যালয়গুলোয় সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো কার্যকরী মনিটরিং ব্যবস্থা নেই। সরকারি মনিটরিং মানেই রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সর্বশেষ প্রকাশিত শিক্ষা পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে ২০ হাজার ১৭৯টি। এগুলোর মধ্য সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাত্র ৬৮৩টি। তার মানে হচ্ছে, দেশের মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৩ শতাংশ সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হচ্ছে। বাকি সাড়ে উনিশ হাজার বিদ্যালয়ই পরিচালিত হচ্ছে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়। এর বাইরে প্রায় ছয় হাজার দাখিল মাদরাসাও রয়েছে।
সঠিক ও উপযুক্ত বিনিয়োগের অভাবে নানা ধরনের সংকটে ভুগছে দেশের মাধ্যমিক শিক্ষা। ব্যানবেইসের সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষক রয়েছেন ২ লাখ ৫২ হাজার ৫০৫ জন। এর মধ্যে বিএড, বিপিএ, এমএড এ ধরনের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ১ লাখ ৬৭ হাজার ৬৫২ জন। সে হিসাবে মাধ্যমিকে প্রায় ৮৫ হাজার শিক্ষক এখনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করছেন, যা মোট শিক্ষকের ৩৩ দশমিক ৬ শতাংশ।
এ ছাড়া অর্থের অভাবে অনেক বেসরকারি বিদ্যালয়ই প্রয়োজনীয়সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারে না। বেসরকারি স্কুলগুলোয় অভিভাবকদের শিক্ষা ব্যয়ের পরিমাণও অনেক বেশি। এ ব্যয়ভার বহন করতে না পারায় শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ মাধ্যমিক পর্যায় থেকে ঝরে পড়ছে। করোনা মহামারি এ অবস্থাকে আরও নড়বড়ে করে দিয়েছে। কোভিডের কারণে মাধ্যমিক পর্যায়ে ৪৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর ঝরে পড়ার একটি খবর বিভিন্ন পত্রিকায় এসেছে। এটি উদ্বেগজনক।
দেশের গোটা শিক্ষা ব্যবস্থায় ঝরে পড়ার হার সবচেয়ে বেশি মাধ্যমিকে। শিক্ষা পরিসংখ্যান প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ কোটি ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৩২৩। এর মধ্যে ছাত্রী ৫৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ। মাধ্যমিকে এসব শিক্ষার্থীর ৩৬ দশমিক ৭৩ শতাংশই দশম শ্রেণি শেষ করার আগে ঝরে পড়ে। শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার পেছনে নানাবিধ কারণ রয়েছে। এর উল্লেখযোগ্যগুলো হচ্ছে-পরিবার অন্যত্র চলে যাওয়া, তাৎক্ষণিকভাবে স্কুলের ব্যয় বহনে অক্ষমতা, মা-বাবাকে গৃহস্থালি কাজে সহায়তা, উপাজর্ন বা ভাগ্যান্বেষণে নেমে পড়া, লেখাপড়ায় আর আগ্রহ না পাওয়া, স্কুলে যেতে নিরাপদ বোধ না করা, যাতায়াতে যানবাহন সমস্যা ইত্যাদি।
ছেলেদের ক্ষেত্রে ১৭ দশমিক ১৫ আর মেয়েদের ক্ষেত্রে ১৭ দশমিক ৫৬ শতাংশই মা-বাবাকে ঘরের বা উপার্জনের কাজে সহায়তার কারণে স্কুলে যায় না। স্কুলে যাওয়ার ক্ষেত্রে এরপর সবচেয়ে বড় বাধা দুর্যোগ-পরবর্তী যানবাহনের সংকট। ১৬ দশমিক ৩০ শতাংশ ছেলে এবং ১৭ দশমিক ২৭ শতাংশ মেয়ে এ কারণে স্কুলে যায় না। উভয় ক্ষেত্রে স্কুলে না যাওয়ার তৃতীয় কারণ লেখাপড়ায় আগ্রহ না থাকা। ১০ দশমিক ৯৭ শতাংশ ছেলে ও ১১ দশমিক ২২ শতাংশ মেয়ে এ কারণে স্কুলে যায় না।
রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় প্রতিবছরই দু-একটি করে বিদ্যালয় সরকারি করা হচ্ছে। বেছে বেছে সরকারি করা হচ্ছে; অর্থাৎ তেল মাথায় তেল দেওয়া হচ্ছে। যদি এমন হতো, পিছিয়ে পড়া এলাকাগুলোর বিদ্যালয় সরকারি করা হচ্ছে, তাহলে বোঝা যেত-সরকার দরিদ্র শ্রেণি, পিছিয়ে পড়া এলাকার শিক্ষার্থীদের জন্য এ ব্যবস্থা করেছে; কিন্তু সেটি তো হচ্ছে না।
শহর কিংবা উপজেলার ভালো স্কুলটি সরকারি করা হচ্ছে, যেখানে ইতোমধ্যে ভালো ভালো শিক্ষক রয়েছেন, অভিভাবকরা অনেকটাই সচ্ছল, তদুপরি সরকারি স্কুলের টিউশন ফি নামমাত্র। আর প্রত্যন্ত এলাকার শিক্ষার্থীরা না পাচ্ছে ভালো বিদ্যালয়, না পাচ্ছে ভালো শিক্ষা। প্রতিষ্ঠান থেকে তাদেরকে শিক্ষা কিনতে হচ্ছে উচ্চমূল্যে, যে সামর্থ্য অধিকাংশ পরিবারের নেই। নানা কারণে আমাদের দেশের মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষা এখনো অনেকটাই অবহেলিত রয়ে গেছে।
আর মাধ্যমিক শিক্ষা সরকারি ও বেসরকারি দু’পর্যায়ে রাখার কারণেই সৃষ্টি হয়ে বড় ধরনের শিক্ষা বৈষম্য। শহর ও গ্রামভেদে শিক্ষার সুযোগ এক ও অভিন্ন নয়। দেশে হাজার হাজার মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকলেও সরকারি উদাসীনতা, প্রয়োজনীয় তদারকীর অভাব, শিক্ষাপ্রশাসনের লাগামীন দুর্নীতি, একশ্রেণির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের বাণিজ্যিক মনোভাবের কারণে আমাদের দেশে মাধ্যমিক শিক্ষা খুব একটা সামনে এগুতে পারিনি। যার প্রভাব পড়ছে দেশের উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রেও।
মূলত, মাধ্যমিক শিক্ষা হচ্ছে উচ্চশিক্ষার প্রবেশ দ্বার। তাই এ শিক্ষাকে মানহীন রেখে আমাদের জাতীয় শিক্ষাকে কোন ভাবেই কাঙ্খিতমানে পৌঁছানো সম্ভব নয়। তাই মাধ্যমিক শিক্ষার ভুলত্রুতি ও দুর্বলতাগুলো সনাক্ত করে তা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সমাধান করা দরকার। সাথে সাথে এখাতে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দও সময়ের দাবি। অন্যথায় দেশের মাধ্যমিক শিক্ষাকে কাঙ্খিতমানে পৌঁছানো সম্ভব হবে না।
তাছাড়া, নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের জন্য মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের শতভাগ আন্তরিক সহযোগিতা ছাড়া এই বিরাট চ্যালেঞ্জ সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়; সংগত কারণে শিক্ষকদের জীবন মানের উন্নয়ন ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য তাদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই! ইতোমধ্যে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকগণ নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের সঙ্গে প্রথম থেকেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সাফল্য দেখিয়েছেন। বিশেষ করে সম্প্রতি নতুন কারিকুলামের জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে মাস্টার ট্রেইনার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে শিক্ষকদের দায় দায়িত্ব আরো বেড়ে গিয়েছে।
এক্ষেত্রে তাঁরা (মাস্টার ট্রেইনার শিক্ষকগণ) শতভাগ সাফল্য দেখিয়েছেন বলে সাধারণ শিক্ষকগণ ইতিবাচক মতামত প্রদান করেছেন। শিক্ষকগণ নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে তাদের জায়গা থেকে শতভাগ আন্তরিক সহযোগিতার সাথে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করছেন। এখন সরকারের পক্ষ থেকে উচিৎ শিক্ষকদের পাশে দাঁড়ানো! কেননা এই কারিকুলাম বাস্তবায়নে শিক্ষকদের অতিরিক্ত কিছু দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি প্রাইভেট/টিউশনির সুযোগও বন্ধ হতে চলেছে; তাই, শিক্ষকদের বেতন ভাতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত এখন সময়ের অনিবার্য দাবি।
আর তাই, শিক্ষা বান্ধব সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার সরকার আগামী অর্থবছরে এবং সরকারের নতুন এই মেয়াদের শুরুতেই শিক্ষকদের জন্য একটি মান সম্মত স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্ৰহণ করবেন বলে আমরা প্রত্যাশা করি।
লেখক
মোঃ ওমর ফারুক
সহকারী শিক্ষক (বাংলা),
সরকারি করোনেশন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, খুলনা
জেলা মাস্টার ট্রেইনার।
আপলোডকারীর তথ্য

Banglar Alo News

hello
জনপ্রিয় সংবাদ

টানা ৬ ঘণ্টা বৃস্টিতে পিরোজপুরবাসীর প্রাণে বইছে স্বস্তি

মাধ্যমিক শিক্ষা, শিক্ষকের উন্নয়ন ও নতুন কারিকুলাম!

আপডেট সময় ১২:৪২:৩৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ১০ জানুয়ারী ২০২৪

 

 

 

মাধ্যমিক শিক্ষা, শিক্ষকের উন্নয়ন ও নতুন কারিকুলাম!
আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখন পর্যন্ত সেই ঔপনিবেশিক বৃত্তেই রয়ে গেছে! ফলে আমরা শিক্ষাকে এখন পর্যন্ত কাঙ্খিতমানে পৌঁছাতে পারিনি। বিশেষ করে দেশের মাধ্যমিক শিক্ষা এখনো অনেকটাই পশ্চাৎপদ রয়ে গেছে। পৃথিবীর অধিকাংশ রাষ্ট্রগুলো তাদের মাধ্যমিক শিক্ষাকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে, যদিও আমাদের দেশে এখনও এই সেক্টরটি অবহেলিতই রয়ে গেছে। সরাসরি যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে উচ্চ শিক্ষার ওপর।
যেকোনো দেশের শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় হচ্ছে মাধ্যমিক শিক্ষাস্তর। প্রাথমিক ও উচ্চ শিক্ষাস্তরের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে মাধ্যমিক শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। এই শিক্ষাস্তরে অর্জিত জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গিই একজন শিক্ষার্থীকে ভবিষ্যতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ এবং দেশ ও জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সহায়তা করে।
অথচ আমাদের দেশে মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরটি সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত এবং বঞ্চিত! এটা সকলের জানা যে, এই সেক্টরে যোগদানকারী একজন শিক্ষককে তার যোগদানকালীন পদে থেকেই অবসরে যেতে হয়! পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এমন ঘটনার নজির নেই! তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবং সাবেক আমলা ডঃ আকবর আলী খান বেশ কয়েক বছর আগে একটি সেমিনারে বলেছিলেন- একজন চাকরিজীবীর সবচেয়ে বড় একটি অধিকারের বিষয় হলো কর্মকালীন সময়ে তার প্রমোশন বা পদোন্নতি। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত দক্ষতা অর্জন সাপেক্ষে একজন কর্মচারীর জন্য পদোন্নতি পাওয়া তার অধিকারের মধ্যে পড়ে। অথচ দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো আমাদের দেশের মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরে হাজারো শিক্ষক একই পদে যোগদান করে দীর্ঘ ৩০-৩২ বছর পর্যন্ত শিক্ষকতার মহান পেশায় নিজেকে উৎসর্গ করেও একই “সহকারী শিক্ষক” পদে থেকেই অবসরে গিয়েছেন!
এ দেশের বুদ্ধিজীবী, আমলা, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ চান যে শিক্ষার মান উন্নয়ন হোক। এখন বলুন তো শিক্ষকের মান উন্নয়ন নিয়ে আপনারা নীরব কেন? কোনো জাতির শিক্ষার বাহক হল শিক্ষক। শিক্ষক যদি ভালো না থাকেন, তবে জাতির জন্য উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা কিভাবে তারা বহন করবেন এবং বিস্তার ঘটাবেন; দয়া করে বলবেন কি? আসলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় এদেশের বড় বড় কর্তা ব্যক্তিরা বা রাষ্ট্রের কর্ণধারগণ বোধহয় মাধ্যমিক স্তর বাদ দিয়েই শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করেছিলেন! তা না হলে তাদের জীবনের গঠনকালীন সময়ের সম্মানিত শিক্ষকদের পেশাটিকে আকর্ষণীয় এবং সামাজিকভাবে মর্যাদার আসনে আসীন করতে তারা কেন কোনো ভূমিকা রাখছেন না?
আমাদের জাতীয় বাজেটে শিক্ষা ক্ষেত্রে বাজেট অপ্রতুল। সামগ্ৰিক শিক্ষার পাশাপাশি মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। শুধু ভবন নির্মাণের জন্য উন্নয়ন ব্যয় কেন? শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষকদের মানসম্মত বেতন দেওয়ার জন্য বাজেটে বরাদ্দের উদ্যোগ কেন নেওয়া হয় না? আজকে একজন শিক্ষক যদি ভালো থাকেন শিক্ষার বাহক হিসেবে শিক্ষার্থীদের উন্নত ও মানসম্মত শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের আন্তরিকতা স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে।
বাংলাদেশে একজন শিক্ষকের যে বেতন-ভাতা এমন নিম্ন বেতন পৃথিবীর আর কোনো দেশের শিক্ষককে দেওয়া হয় বলে আমার জানা নেই! এর ফল হিসেবে আমরা যা দেখতে পাচ্ছি তার একটি উদাহরণ আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করছি: সুলেখক, সুবক্তা ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার তার স্মৃতিচারণ মূলক একটি গ্রন্থে লিখেছেন- একদিন তিনি ছাত্রদের জিজ্ঞেস করেন- তোমরা কে কে শিক্ষক হতে চাও? কিন্তু দুর্ভাগ্য! একজন শিক্ষার্থী ও সেদিন শিক্ষক হওয়ার জন্য হাত তুলেনি! কি বুঝলেন? শিক্ষকতার মত গুরুত্বপূর্ণ এই মহান পেশাটিকে আকর্ষণীয় এবং সামাজিকভাবে মর্যাদার উচ্চ আসনে নিতে না পারার কারণে আজ আমাদের সামনে এই চিত্রটা ধরা পড়লো!
আর যদি একজন শিক্ষককে উচ্চ বেতন এবং উন্নততর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জাতি গঠনের কারিগর হিসেবে গড়ে তোলা যেতো, একজন শিক্ষক যদি সামাজিকভাবে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত থাকতেন; তবে স্যারের শিক্ষার্থীরা নিশ্চয়ই সেদিন শিক্ষক হওয়ার জন্য হাত তোলার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতো! তাই নয় কি? সামাজিক মর্যাদা এবং আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে শিক্ষকদের যদি এভাবে সমাজের অবহেলিত অংশ হিসেবে ফেলে রাখা হয়, তবে আগামী প্রজন্ম মেধাবী শিক্ষকদের সংস্পর্শ থেকে বঞ্চিত হবে। আর এর ফলে তুলনামূলক দুর্বল ও কম মেধাবী শিক্ষকদের কাছে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কি শিক্ষা লাভ করবে-এ বিষয়টি আমাদের কর্তা ব্যক্তিরা ও রাষ্ট্রপরিচালকগণ ভেবে দেখেছেন কি?
আমাদের দেশে ছাত্র শিক্ষক অনুপাতের বিশাল চ্যালেঞ্জ, প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষক নিয়োগ, দুর্বল পরিদর্শন ব্যবস্থা, বিভিন্ন মানদন্ডে ও তথ্যউপাত্তের প্রেক্ষিতে সর্বজন স্বীকৃত দুর্নীতির শীর্ষে থাকা শিক্ষা প্রশাসন এবং অবৈজ্ঞানিক মনিটরিং ও দুর্বল পরিদর্শন ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা! তথাপিও আমাদের সম্মানিত শিক্ষকদের আন্তরিকতা এবং জাতির প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে তাঁরা নিরলস পরিশ্রম করে আমাদেরই সন্তানদের আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখে চলেছেন। উপরোক্ত চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখেও তাঁদের যে অবদান তার জন্য বাংলাদেশের সকল পর্যায়ের বিশেষ করে মাধ্যমিক স্তরের অবহেলিত শিক্ষকদেরকে জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।
দেশের মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশের বেশি মানুষের বসবাস গ্রামাঞ্চলে। আর গ্রামাঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষই দরিদ্র ও অশিক্ষিত। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে শিক্ষার হার বাড়াতে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতায় নানা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও প্রতিকূলতার ফাঁদে পড়ে গ্রামাঞ্চলে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা বেহাল দশায় পরিণত হয়েছে। সরকারি আইন অমান্য ও সংশ্লিষ্টদের লাগামহীন দুর্নীতির কারণে প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে মেধাহীন হয়ে পড়ছে এসব শিক্ষার্থী। ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের চিন্তায় হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে অভিভাবক মহল।
নানাবিধ অনিয়মের ফলে দীর্ঘদিনের পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হারাচ্ছে স্ব স্ব ঐতিহ্য। শহরাঞ্চলের মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার মান তুলনামূলক ভাবে ভালো থাকলেও তা এখনো বৈশি^ক মানে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। আর এক্ষেত্রে সরকারের বাজেট বরাদ্দে অপ্রতুলতাও অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যখন মাধ্যমিক শিক্ষাকে এগিয়ে নেয়ার জন্য বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখছে, তখন এক্ষেত্রে আমরা সেকেলে বৃত্তেই রয়ে গেছি।
গ্লোবাল পার্টনারশিপের এক বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশে মাথাপিছু জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) বিপরীতে মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয়ের পরিমাণ ১০ দশমিক ২ শতাংশ, যেখানে ভারতে এ হার ১৬ দশমিক ৮২ শতাংশ। পাকিস্তান মাথাপিছু জিডিপির বিপরীতে মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় করে ১৫ দশমিক ২২ শতাংশ। এ ছাড়া মালয়েশিয়ায় মাথাপিছু জিডিপির ২২ দশমিক ৯৭ এবং সিঙ্গাপুর ২২ দশমিক ২২ শতাংশ ব্যয় করে। ইউনেস্কো ইনস্টিটিউট অব স্ট্যাটিসটিকসের (ইউআইএস) তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে ‘এডুকেশন সেক্টর অ্যানালাইসিস (ইএসএ) ফর বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরেছে গ্লোবাল পার্টনারশিপ। পাঁচটি দেশের তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায়, মাথাপিছু জিডিপির বিপরীতে মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয়ে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।
একথা ঠিক যে, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপক প্রসার হয়েছে। তবে তা পরিকল্পিত উপায়ে ঘটেনি। বিশেষ করে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষায় এ সংকট বেশ প্রকট। গত পাঁচ দশকে দেশে হাজার হাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়া হয়েছে, যার প্রায় সবই বেসরকারি। আর মাধ্যমিক বিদালয়ের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেলেও শিক্ষার যথাযথ মাননিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি।
মূলত, শিক্ষার মাধ্যমিক স্তর হচ্ছে গোটা শিক্ষাব্যবস্থার মেরুদন্ড। বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় পরিচালনার জন্য রয়েছে একটি স্থানীয় কমিটি, যা ‘স্কুল ম্যানেজিং কমিটি’ নামে পরিচিত। শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় প্রতিনিধির সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে শিক্ষাকে ‘সাসটেইনেবল’ করা ও মান উন্নীত করার জন্য এ ব্যবস্থা। কিন্তু এ ব্যবস্থাই মাধ্যমিক শিক্ষার মানকে তলানিতে নিয়ে গেছে। যা অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত।
নানাবিধ কারণেই আমাদের দেশের মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থা স্থবির হয়ে পড়েছে। অপরাজনীতি ও আর অযোগ্যদের দৌরাত্ম্য এর অন্যতম কারণ হিসাবে বিবেচনা করছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। আবার অন্যদিকে রয়েছে শিক্ষকদের অপ্রতুলতাও। অনেক প্রতিষ্ঠানেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক নেই। নাজুক অবস্থানে থাকছে অবকাঠামো। যদিও বর্তমান সরকারের আমলে অবকাঠামগত উন্নয়নে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহ যথেষ্ট এগিয়েছে। তবে কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়াই উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করছেন। ফলে মানসম্পন্ন পাঠদান ব্যহত হচ্ছে।
এ ছাড়া শিক্ষার ব্যয় বেশি হওয়ায় স্বল্প আয়ের পরিবারের অনেক শিক্ষার্থীই মাধ্যমিকে এসে ঝরে পড়ছে। গত কয়েক বছরে কিছুসংখ্যক প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হলেও ঢাকা মহানগর খুলনা সিলেট ও বরিশাল মহানগর ব্যতীত মোটাদাগে দেশের অন্য কোন মহানগর জেলা শহরে সরকারি উদ্যোগে ভালোমানের মাধ্যমিক বিদ্যালয় গড়ে ওঠেনি। তাই স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরও মাধ্যমিক শিক্ষার ভিত অনেকটাই দুর্বল।
শিক্ষার মান এখন ধরা হয়, কতজন শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে; তাদের মধ্যে কতজন পাস করেছে! একটু ভালো বিদ্যালয় হলে বলা হয়, কতজন জিপিএ-৫ পেয়েছে। যেখানে শিক্ষাদান ও পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় সমস্যা থেকে গেছে, সেখানে একটি পাবলিক পরীক্ষার মূল্যায়ন যে শিক্ষার মানের কথা বলে না, সেটি বোধ হয় আর ব্যাখ্যা করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। পাবলিক পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নের যে পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, তাতে শিক্ষার্থীরা খাতায় যাই লিখুক; ফেল করার করার সুযোগই থাকে না। ফলে আমাদের মাধ্যমিক শিক্ষা মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি।
এসব সত্ত্বেও সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের কিছু নামকরা মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে, যে গুলোতে পড়াশোনা করলে বিদ্যালয়গুলোর নিজস্ব ব্যবস্থাপনা, কালচার, ট্র্যাডিশন, পদ্ধতি এবং শিক্ষকদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে শিক্ষার্থীরা বেসিক কিছু জ্ঞান অর্জন করে, বাস্তবধর্মী কিছু দক্ষতা অর্জন করে, যা সাধারণত প্রচলিত বিদ্যালয় ব্যবস্থায় হয় না। আর এসুযোগটা বিশেষ শ্রেণির জন্য ও সীমিত পরিসরের।
মূলত, প্রয়োজনীয় জমি ও সঠিক পরিকল্পনার অভাব আর ব্যবসায়িক মনোভাবের কারণেই আমাদের দেশের মাধ্যমিক শিক্ষা এখনও মানহীনই রয়ে গেছে । ভালো মানের বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার জন্য নেই কোনো সরকারি উদ্যোগ, নেই ব্যক্তি বা সামাজিক উদ্যোগ। ফলে দেশে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়লেও লক্ষ্য অর্জনে তেমন একটা সহায়ক হচ্ছে না।
বস্তুত, মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষায় দুর্বলতা থেকে গেলে গোটা ব্যবস্থার ভিতই নড়বড়ে হয়ে পড়ে। আর এটিই আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। সঠিক পরিকল্পনার অভাবে অনেকটা বিচ্ছিন্নভাবে পরিচালিত হচ্ছে মাধ্যমিকের প্রতিষ্ঠান। নানা ক্যাটাগরিতে বিভক্ত বিদ্যালয়গুলোয় সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো কার্যকরী মনিটরিং ব্যবস্থা নেই। সরকারি মনিটরিং মানেই রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সর্বশেষ প্রকাশিত শিক্ষা পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে ২০ হাজার ১৭৯টি। এগুলোর মধ্য সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাত্র ৬৮৩টি। তার মানে হচ্ছে, দেশের মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৩ শতাংশ সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হচ্ছে। বাকি সাড়ে উনিশ হাজার বিদ্যালয়ই পরিচালিত হচ্ছে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়। এর বাইরে প্রায় ছয় হাজার দাখিল মাদরাসাও রয়েছে।
সঠিক ও উপযুক্ত বিনিয়োগের অভাবে নানা ধরনের সংকটে ভুগছে দেশের মাধ্যমিক শিক্ষা। ব্যানবেইসের সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষক রয়েছেন ২ লাখ ৫২ হাজার ৫০৫ জন। এর মধ্যে বিএড, বিপিএ, এমএড এ ধরনের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ১ লাখ ৬৭ হাজার ৬৫২ জন। সে হিসাবে মাধ্যমিকে প্রায় ৮৫ হাজার শিক্ষক এখনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করছেন, যা মোট শিক্ষকের ৩৩ দশমিক ৬ শতাংশ।
এ ছাড়া অর্থের অভাবে অনেক বেসরকারি বিদ্যালয়ই প্রয়োজনীয়সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারে না। বেসরকারি স্কুলগুলোয় অভিভাবকদের শিক্ষা ব্যয়ের পরিমাণও অনেক বেশি। এ ব্যয়ভার বহন করতে না পারায় শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ মাধ্যমিক পর্যায় থেকে ঝরে পড়ছে। করোনা মহামারি এ অবস্থাকে আরও নড়বড়ে করে দিয়েছে। কোভিডের কারণে মাধ্যমিক পর্যায়ে ৪৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর ঝরে পড়ার একটি খবর বিভিন্ন পত্রিকায় এসেছে। এটি উদ্বেগজনক।
দেশের গোটা শিক্ষা ব্যবস্থায় ঝরে পড়ার হার সবচেয়ে বেশি মাধ্যমিকে। শিক্ষা পরিসংখ্যান প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ কোটি ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৩২৩। এর মধ্যে ছাত্রী ৫৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ। মাধ্যমিকে এসব শিক্ষার্থীর ৩৬ দশমিক ৭৩ শতাংশই দশম শ্রেণি শেষ করার আগে ঝরে পড়ে। শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার পেছনে নানাবিধ কারণ রয়েছে। এর উল্লেখযোগ্যগুলো হচ্ছে-পরিবার অন্যত্র চলে যাওয়া, তাৎক্ষণিকভাবে স্কুলের ব্যয় বহনে অক্ষমতা, মা-বাবাকে গৃহস্থালি কাজে সহায়তা, উপাজর্ন বা ভাগ্যান্বেষণে নেমে পড়া, লেখাপড়ায় আর আগ্রহ না পাওয়া, স্কুলে যেতে নিরাপদ বোধ না করা, যাতায়াতে যানবাহন সমস্যা ইত্যাদি।
ছেলেদের ক্ষেত্রে ১৭ দশমিক ১৫ আর মেয়েদের ক্ষেত্রে ১৭ দশমিক ৫৬ শতাংশই মা-বাবাকে ঘরের বা উপার্জনের কাজে সহায়তার কারণে স্কুলে যায় না। স্কুলে যাওয়ার ক্ষেত্রে এরপর সবচেয়ে বড় বাধা দুর্যোগ-পরবর্তী যানবাহনের সংকট। ১৬ দশমিক ৩০ শতাংশ ছেলে এবং ১৭ দশমিক ২৭ শতাংশ মেয়ে এ কারণে স্কুলে যায় না। উভয় ক্ষেত্রে স্কুলে না যাওয়ার তৃতীয় কারণ লেখাপড়ায় আগ্রহ না থাকা। ১০ দশমিক ৯৭ শতাংশ ছেলে ও ১১ দশমিক ২২ শতাংশ মেয়ে এ কারণে স্কুলে যায় না।
রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় প্রতিবছরই দু-একটি করে বিদ্যালয় সরকারি করা হচ্ছে। বেছে বেছে সরকারি করা হচ্ছে; অর্থাৎ তেল মাথায় তেল দেওয়া হচ্ছে। যদি এমন হতো, পিছিয়ে পড়া এলাকাগুলোর বিদ্যালয় সরকারি করা হচ্ছে, তাহলে বোঝা যেত-সরকার দরিদ্র শ্রেণি, পিছিয়ে পড়া এলাকার শিক্ষার্থীদের জন্য এ ব্যবস্থা করেছে; কিন্তু সেটি তো হচ্ছে না।
শহর কিংবা উপজেলার ভালো স্কুলটি সরকারি করা হচ্ছে, যেখানে ইতোমধ্যে ভালো ভালো শিক্ষক রয়েছেন, অভিভাবকরা অনেকটাই সচ্ছল, তদুপরি সরকারি স্কুলের টিউশন ফি নামমাত্র। আর প্রত্যন্ত এলাকার শিক্ষার্থীরা না পাচ্ছে ভালো বিদ্যালয়, না পাচ্ছে ভালো শিক্ষা। প্রতিষ্ঠান থেকে তাদেরকে শিক্ষা কিনতে হচ্ছে উচ্চমূল্যে, যে সামর্থ্য অধিকাংশ পরিবারের নেই। নানা কারণে আমাদের দেশের মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষা এখনো অনেকটাই অবহেলিত রয়ে গেছে।
আর মাধ্যমিক শিক্ষা সরকারি ও বেসরকারি দু’পর্যায়ে রাখার কারণেই সৃষ্টি হয়ে বড় ধরনের শিক্ষা বৈষম্য। শহর ও গ্রামভেদে শিক্ষার সুযোগ এক ও অভিন্ন নয়। দেশে হাজার হাজার মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকলেও সরকারি উদাসীনতা, প্রয়োজনীয় তদারকীর অভাব, শিক্ষাপ্রশাসনের লাগামীন দুর্নীতি, একশ্রেণির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের বাণিজ্যিক মনোভাবের কারণে আমাদের দেশে মাধ্যমিক শিক্ষা খুব একটা সামনে এগুতে পারিনি। যার প্রভাব পড়ছে দেশের উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রেও।
মূলত, মাধ্যমিক শিক্ষা হচ্ছে উচ্চশিক্ষার প্রবেশ দ্বার। তাই এ শিক্ষাকে মানহীন রেখে আমাদের জাতীয় শিক্ষাকে কোন ভাবেই কাঙ্খিতমানে পৌঁছানো সম্ভব নয়। তাই মাধ্যমিক শিক্ষার ভুলত্রুতি ও দুর্বলতাগুলো সনাক্ত করে তা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সমাধান করা দরকার। সাথে সাথে এখাতে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দও সময়ের দাবি। অন্যথায় দেশের মাধ্যমিক শিক্ষাকে কাঙ্খিতমানে পৌঁছানো সম্ভব হবে না।
তাছাড়া, নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের জন্য মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের শতভাগ আন্তরিক সহযোগিতা ছাড়া এই বিরাট চ্যালেঞ্জ সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়; সংগত কারণে শিক্ষকদের জীবন মানের উন্নয়ন ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য তাদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই! ইতোমধ্যে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকগণ নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের সঙ্গে প্রথম থেকেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সাফল্য দেখিয়েছেন। বিশেষ করে সম্প্রতি নতুন কারিকুলামের জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে মাস্টার ট্রেইনার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে শিক্ষকদের দায় দায়িত্ব আরো বেড়ে গিয়েছে।
এক্ষেত্রে তাঁরা (মাস্টার ট্রেইনার শিক্ষকগণ) শতভাগ সাফল্য দেখিয়েছেন বলে সাধারণ শিক্ষকগণ ইতিবাচক মতামত প্রদান করেছেন। শিক্ষকগণ নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে তাদের জায়গা থেকে শতভাগ আন্তরিক সহযোগিতার সাথে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করছেন। এখন সরকারের পক্ষ থেকে উচিৎ শিক্ষকদের পাশে দাঁড়ানো! কেননা এই কারিকুলাম বাস্তবায়নে শিক্ষকদের অতিরিক্ত কিছু দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি প্রাইভেট/টিউশনির সুযোগও বন্ধ হতে চলেছে; তাই, শিক্ষকদের বেতন ভাতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত এখন সময়ের অনিবার্য দাবি।
আর তাই, শিক্ষা বান্ধব সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার সরকার আগামী অর্থবছরে এবং সরকারের নতুন এই মেয়াদের শুরুতেই শিক্ষকদের জন্য একটি মান সম্মত স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্ৰহণ করবেন বলে আমরা প্রত্যাশা করি।
লেখক
মোঃ ওমর ফারুক
সহকারী শিক্ষক (বাংলা),
সরকারি করোনেশন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, খুলনা
জেলা মাস্টার ট্রেইনার।