মাহফুজ রাজা, কিশোরগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি ;
গ্রাম মানে সহজ সরল একটা শব্দ অবর্ণনীয় আবেগ মিশ্রিত প্রশান্তির নিবিড় আলিঙ্গন। আমি গ্রামেরই ছেলে, গ্রামের ছেলেরা একটু সহজ সরলই হয়, আমিও তা থেকে বঞ্চিত নয়!তবে অদম্য ডানপিটে দুরন্ত চঞ্চলতায় কেটেছে শৈশব।যেখানেই থাকি এক মূহুর্তের জন্যও গ্রামের মনোলোভা সৌন্দর্য মনের বারান্দায় যখন ঊঁকি দেয় ব্যাকুল হয়ে পড়ি গ্রামের চিরচেনা রুপ অবলোকন করতে এবং গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলিকে দেখে নয়নের স্বাদ মিঠাতে।
অপার সৌন্দর্যের লীলা নিকেতন কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুর থানাধীন সিদলা ইউনিয়নের “সাহেবের চর” গ্রাম। উপজেলা থেকে প্রায় কয়েক কিলোমিটার দূরে। উপজেলার চরাঞ্চলগুলির মাঝে একটি সাহেবের চর গ্রাম যার সিনা বরাবর বয়ে চলেছে বাংলাদেশের প্রধান সারির নদ-নদীগুলির একটি ব্রম্মপুত্র নদ।সাহেবের চর গ্রামের মাটি ছুঁয়ে আবার ময়মনসিংহের পাগলা থানার লাগাতা ভাব।
ডিম্বাকার নকশায় এ গ্রামটি সুনির্দিষ্ট কোন প্রমান না থাকলেও স্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিরা ধারনা করে প্রায় ৫০০ বছর পূর্বে সৃষ্টি এ গ্রামটি। কাওনা থেকে মাওনা যখন বিশাল জলরাশীর মেলা ছিল তার বুকে জেগে উঠা চর থেকে সৃষ্টি হওয়া সাহেবের চর গ্রাম।ইতিহাস ঐতিহ্যের পবিত্র ঘাটি এ জনপদটি। গ্রামের মধ্যমনি হয়ে অবস্থান নিয়েছে আল্লাহর বিশিষ্ট ওলি হযরত সুলু শাহ(সুলেমান শাহ)(রঃ)।তিনার পবিত্র মাজার শরিফ ঘরে উঠেছে গ্রামটির ঠিক মাঝখানটায়।ধারণা করা হয় এ গ্রামের প্রথম বসতী হযরত সুলু শাহ (রঃ)।
সাহেবের চর গ্রামের রূপ যেন ছুঁয়ে ছুঁয়ে পড়ে। তার যৌবনা শরীরে সব সময় জড়িয়ে থাকে লাল সবুজের একটা শাড়ী। আরো কত অলংকারে যে তার শরীরখানা শোভিত তা আমি লিখে শেষ করতে পারবো না। এই দরুন আম, জাম, নারিকেল, সুপারি, তাল, লিচু, কাঠাল,বড়ই প্রভৃতি ফলে আমাদের গ্রামখানি যেন নুয়ে পড়বে পড়বে অবস্থা।, বর্ষাকালে চারদিকে যখন পানিতে টইটুম্বুর থাকে। তখন মনের ভেতর থেকে রোমান্স ডাক দিয়ে উঠে। জমির পাশে কলমীর শাকের বাগান, তাতে ফুটতো সাদা সাদা ফুল। তার উপর খেলা করতো নানা রঙের ঘাস ফড়িং আর রং বেরংয়ের প্রজাপতি। বাড়ীর পাশে সুপারি গাছ। গাছগুলো তাদের ন্যাংটো শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মাঝে মাঝে বাতাসে দুলে উঠে তার শরীর। মাথাটা ঢাকা থাকতো একগুচ্ছ সবুজ পাতায়। ঠিক যেন গাঁয়ের মেয়েদের চুলের খোঁপা।
ব্রম্মপুত্র নদের তীরবর্তী খেসারি, মসুর মাশকলাই ক্ষেত,মাঠের পর মাঠ বাদামের আচ্ছাদন, ধান,গম,ভুট্টা কিংবা বিভিন্ন রকম সবজি উৎপাদনের জন্যই মনে হয় তৈরি এ গ্রামের মাটি।সোনা ফলানো মনোরম প্রকৃতির অন্তরালে ভয়ংকর সর্বনাশের ছিল হাতছানি। বর্ষা মৌসুমে ব্রম্মপুত্রের কড়াল গ্রাসে নিমজ্জিত হতো আবাদী জমি।বছরের পর বছর গ্রামের অস্তিত্বে আঘাত হানতে হানতে একটা সময় নদের গর্ভে তলিয়ে যেথে থাকে বসত বাড়ী,বহু পরিবার হয়ে পড়ে কোনঠাসা। বেঁচে থাকার প্রয়াসে অসহায় মানুষগুলি সমাজ বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। কেউ বসতি স্থাপন করে গ্রামের অন্যত্র কেউবা এ জনপদ ছেড়ে অন্যকোন লোকালয়ে। আবার নদের ওপারে বালুচরে অসংখ্য পরিবার বসতি স্থাপন করেন।তারা পরিনত হয় নব্য সমাজে, নাম দেয় আল কুবা নতুন চর।যদিও সরকারি ভাবে স্বীকৃতির বিষয় হয়ে উঠেনি।
অবশেষে সিদলা ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান জনাব সিরাজ উদ্দীন( এম এ) এর নেতৃত্বে বিভিন্ন ঊর্ধ মহলে তদবির চেষ্টা চলতে থাকে,চেয়ারম্যান কে সঙ্গ দেয় স্থানীয় মিজানুর রহমান, সিদলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল কাদির প্রমুখ। একটা সময় প্রয়াত মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের ডিও লেটার মূলে পাশ হয়ে আসে নদের বাম তীরের প্রতিরক্ষার বাঁধ। গ্রামবাসীর আনন্দে নেচে উঠে আকাশ- বাতাস, মৃত্তিকা, বৃক্ষরাজি।
সাহেবের চর হাজীবাড়ীর আব্দুল ওয়াদুদ জানান,ছোট বেলায় নদের বুকে ঝাঁপাঝাপি, গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্ধা ইত্যাদি স্মৃতি গুলি মনকে দোলা দিয়ে যায়,মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ানোর মতই গ্রাম আমাদের। সাহেবের চর ভাটিপাড়ার আজহারুল ইসলাম, রাজন মিয়া,আবু নাঈম জানান,নৈপুণ্যের শীর্ষ গ্রাম আমাদের
অপার সৌন্দর্যের লীলাক্ষেত্র। যেখানেই থাকি গ্রামের মাটি ও মানুষের টানে বারবার ছুটে আসি।
সাবেক চেয়ারম্যান সিরাজ উদ্দীন বলেন,আমি দেখেছিলাম সাহেবের চরের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য কেমন করে নদের গর্ভে বিলিন হচ্ছে তাই আমি চেয়ারম্যান হবার পর বিভিন্ন মহলে সাহেবের চরের মানুষের দুঃখ -দুর্দশা তুলে ধরতে পেরেছি।আমাদের চেষ্টা এবং মহান আল্লাহ তায়ালার রহমতে অবশিষ্ট
গ্রামটুকু উক্ত বেরি বাঁধের উসিলায় রক্ষা পেলো।