রুবেল হোসাইন (সংগ্রাম)-
মিঠাপুকুর উপজেলার ০২ নং রানীপুকুর ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে ‘পাড়া’ ভিত্তিক রয়েছে আদিবাসীদের বসবাস। উপজেলার সব চেয়ে বেশি “উপজাতি” (সাঁওতাল) রয়েছে এই ইউনিয়নে। রানীপুকুর ইউনিয়নের মমিনপুর উত্তর, দক্ষিণপাড়া, বলদিপুকুর গোপলাপাড়া, দিপ্পাপাড়া,পাচ্চাপাড়া, মাইকেল পাড়া, তাজনগর (পাকরিপাড়া) প্রভূতি পাড়ায় দলবদ্ধভাবে বসবাস করে এ সম্প্রদায়টি।
আদিবাসীদের রয়েছে নিজস্ব মাতৃভাষা, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, সামাজিক প্রথা রীতিনীতি। মূল্যত এরা বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত। সাঁওতাল বা আদিবাসী হলেও অনেকে খৃষ্টান কিংবা সনাতন ধর্মাবলম্বী। অনেকে বিভিন্ন ডালপূজা আর যীশু খ্রীষ্ট ধর্ম পালন করেন। ডালপূজা আর সনাতন ধর্ম ছেড়ে খৃষ্টান ধর্মান্তারিত হওয়ার পেছনে রয়েছে বলদিপুকুর ব্যাপটিষ্ট মিশন কর্তৃপক্ষের বিশেষ অবদান।
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব উপজাতিদের শিক্ষা-সংস্কৃতি, সামাজিক মর্যাদা, আর্থসামাজিক উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা, অধিকার রক্ষায় আইনি সহযোগিতা, চাকরি প্রভূতি বিষয়ে সহযোগিতা করে যাচ্ছে এই সংস্থাটি। সেন্ট মেরিস নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় নামে একটি বিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ রয়েছে এসব উপজাতি শিশুদের। এজি চার্জসহ আরো কয়েকটি স্কুল ও খাওয়া দাওয়ার জন্য আবাসিক ব্যবস্হা রয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে নামমাত্র ফি-নিয়ে চিকিৎসা-সেবা দিয়ে আসছে বলদিপুকুর ব্যাপটিষ্ট মিশন কর্তৃপক্ষ। যেখানে দেশের বিভিন্ন স্হান থেকে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীরাও আসেন চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করতে। স্হানীয়দের কাছে পাদড়ির বাসা নামে পরিচিত।
অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, এনজিও আর দাতা সংস্থা তাদের উন্নয়নে কাজ করলেও কিছুতেই কমছেনা তাদের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরী হাঁড়িয়া নামক নেশা জাতীয় পানি সেবন। সঙ্গে রয়েছে চোলাইমদ তৈরি এবং সেবনের প্রবনতা। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে নিজস্ব রীতিনীতি হলেও ব্যবসায়ীক উদ্দেশ্যে কয়েকটি পরিবার উৎপন্ন এবং মজুদ করায় সেবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে তরুন, তরুণী, বয়স্করা। মাত্রাতিরিক্ত এ্যালকোহল সেবনে এবং বিষক্রিয়ায় বাড়ছে অল্প বয়সে মৃত্যু এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকি।
বলদিপুকুর দক্ষিণ মমিনপুর আদিবাসী পাড়ায় মাত্র ২৪ টি উপজাতি পরিবার রয়েছে। বংশানুক্রমে প্রত্যেক পরিবার হাড়িয়া আর চোলাইমদ উৎপন্ন এবং সেবন করেন। এসব পরিবারের প্রত্যেক বাড়িতে কোন নারী তার স্বামী,কিংবা তাদের সন্তান হারিয়েছেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, জিতেন ত্রির্কী, বিশ্বা পাহান, বধুয়া টপ্য, শুকরা, জোগে, এতোয়া, আনজুস, ফিলিপ, গিলবার্ট, জিতেন কেরকেটা, মাংগা টপ্য চোলাই মদ খেয়ে অল্প বয়সেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন। তাদের হারিয়ে এখন ২৪ পরিবারের ১৫ পরিবারেই স্বামী হারা।
মাত্রাতিরিক্ত মদ খেয়ে ওরা মারা গেলেও থেমে নেই তাদের মাদক ব্যবসা। বিধবা স্ত্রী আর সন্তানরা চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের বাপ দাদার দেখানো পথ। নিজেরা সেবন করছেন, বিক্রি ও করছেন। যে কজন বেঁচে আছেন তারাও মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। শূধু আদিবাসী নয়, অনেক মুসমানেরাও এখানের মদ খেয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। আদিবাসীদেরকে মাদক ব্যবসায় ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন অনেক মুসলমান মাদক কারবারি।
চোলাইমদ উৎপন্ন বিক্রি ও সেবনের পৃষ্ঠপোষক অনেক মুসলমান হাড়িয়ার উপকরণ চালের গুঁড়া, হাড়িয়ার বড়ি, জ্বালানি খড়ি সরবাহ করেন মাসিক লাভে আর কিস্তিতে। চোলাইমদের উপকরণ গুড়, ইউরিয়া, ফসফেট, বড়ি, খড়ি সরবরাহ করে ব্যবসায় শেয়ার থাকেন টাউট বাটপারেরা। কেউ কেউ কথিত স্বামী সেজে শোষণ করছেন এসব নারীদের। মাদক ব্যবসায় দৌরাত্ম বাড়ার কারন এসব কথিত স্বামীরা।
এসব সুবিধাভোগী টাউট আর দালালদের কথা স্বীকার করে খোভ ঝাড়েন, মমিনপুর দক্ষিণ পাড়ার চৌকিদার অনিল, তিনি জানান, তার কথা তার সম্প্রদায়ের লোকজন শুনেনা।রয়েছে বিভিন্ন পরিবার ভিক্তিক সুবিধাবাদীদের ইন্ধন। কেউ ভালো হতে চাইলেও মাসিক সুদের কাছে জিম্মি তারা। তিনিও স্বীকার করেন, বাড়ির কাছেই এসব মদ খেয়ে বাকীরাও স্বাস্থ্যঝুঁকিত। হাসপাতাল আর বাড়িতে নিয়মিত চিকিৎসা চলছে। বাড়ছে উস্কানিমূলক মামলা, যার নেতৃত্বে মুসলিম ইন্ধন দাতারা। রয়েছে একটি বিশেষ সংস্হার মাসিক চাঁদা আদায়ের অভিযোগ।
০২ নং রানীপুকুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম রাঙ্গা জানান, বিধবাদের জন্য শতভাগ বিধবা এবং বয়স্কভাতা প্রদান করা হয়েছে। এখন যারা আদিবাসীদের জমির লোভে পড়ে আছে আর মদের ব্যবসায় যোগানদাতা তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহন করলেই আদিবাসীদের ভালো রাখা সম্ভব। তিনি প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করেন।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফাতেমাতুজ জোহরা জানান, আমরা নিয়মিত মনিটরিং করার চেষ্টা করছি। বিভিন্ন ধরনের সুযোগ সুবিধা এবং কাউন্সিলিং করে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেস্টা অব্যাহত আছে। বলদিপুকুর মমিনপুর আদিবাসী পাড়াসহ সচেতন মহলের দাবি, মাদক ব্যবসায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্হা নেওয়া হউক।