রাজশাহীতে প্রাথমিক শিক্ষায় অচলাবস্থা: এক-তৃতীয়াংশ বিদ্যালয়ে নেই প্রধান শিক্ষক

আপলোড সময় : ১৩-০৯-২০২৫ ০৯:১০:৫৮ অপরাহ্ন , আপডেট সময় : ১৩-০৯-২০২৫ ০৯:১০:৫৮ অপরাহ্ন

মাসুদ রানা রাব্বানী, রাজশাহী:

রাজশাহীতে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা এক গভীর সংকটে নিমজ্জিত। জেলার মোট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি বিদ্যালয়ে কোনো প্রধান শিক্ষক নেই। দীর্ঘকাল ধরে ভারপ্রাপ্ত শিক্ষকদের দ্বারা পরিচালিত হওয়ায় প্রশাসনিক জটিলতা, প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলার অভাব এবং মানসম্মত পাঠদানে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটছে। যা শিশুদের মেধার বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

রাজশাহী জেলায় মোট এক হাজার ৫৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৩৮৯টিতে প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, মামলা, শিক্ষক নিয়োগে জটিলতা, নিয়োগ পরীক্ষায় বিলম্ব এবং পদোন্নতিতে ধীরগতির কারণে এই সংকট দিন দিন প্রকট হচ্ছে। প্রধান শিক্ষকরা শ্রেণি পাঠদান পর্যবেক্ষণ, শিক্ষাক্রম তত্ত¡াবধান এবং মডেল শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন, তাই তাঁদের অনুপস্থিতি শিক্ষা কার্যক্রমকে স্থবির করে দিচ্ছে।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন (রাসিক) সহ জেলার ৯টি উপজেলাতেই এই সংকট বিদ্যমান। ৬১টি পদে আইনি জটিলতা থাকায় নিয়োগ আটকে আছে এবং বাকি ৩২৮টি বিদ্যালয়ে নিয়োগ ও পদোন্নতি কার্যক্রম দীর্ঘকাল ধরে বন্ধ।

এই বিদ্যালয়গুলোতে সহকারী শিক্ষকরা ভারপ্রাপ্ত বা চলতি দায়িত্বে প্রধান শিক্ষকের ভ‚মিকা পালন করছেন। কিন্তু তাঁদের সীমিত প্রশাসনিক ক্ষমতার কারণে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট অনেক কাজই থমকে আছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে, বাগমারায় ৯৭টি বিদ্যালয় (সর্বোচ্চ) গোদাগাড়ীতে ৭১টি বিদ্যালয়, তানোরে ৬২টি বিদ্যালয়, চারঘাটে ৩৮টি বিদ্যালয়, পুঠিয়া: ২৭টি বিদ্যালয়, বাঘায় ২২টি বিদ্যালয়, পবায় ২১টি বিদ্যালয়, দুর্গাপুরে ২১টি বিদ্যালয়, মোহনপুরে ২০টি বিদ্যালয়, রাজশাহী মহানগরীর বোয়ালিয়া থানায় ১০টি বিদ্যালয়।

এর মধ্যে বোয়ালিয়া থানার রাণীনগর নৈশ বিদ্যালয়ে অনিয়ম, দূর্ণীতিতে ভরা। সেই সাথে ছাত্র/ছাত্রীর সংখ্যাও একেবারে নগণ্য। গত (৯ সেপোটম্বর) শিক্ষা মন্ত্রানালয়ের পরিদর্শণ ও নিরিক্ষা অধিদপ্তর, শিক্ষা ভবন থেকে একটি অডিট টিম এসেছিলেন নৈশ বিদ্যালয়ে। শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র এবং সার্টিফিকেট যাছাই বাছাই করে নানা ধরণের ত্রুটি পেয়েছেন তারা।

ছাত্র/ছাত্রী সংখ্যা, ত্রুটি যুক্ত ও সার্টিফিকেটের বিষয়টি গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে স্বীকার করে অডিটর সদস্য মোঃ কাউসার আলী বলেন, আমরা উপরে রিপোর্ট দিলেই স্কুলের এমপিও বন্ধ হয়ে যাবে। অদ্য তারা কোন ব্যবস্থা নিবেন কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়। এছাড়াও নৈশ বিদ্যালয়ে চুরি, ডাকাতি না হলে আলমারী থেকে কয়েকজন শিক্ষকের মূল্যবান কাগজ হারানোর কথাও স্বীকার করেছেন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোসাঃ আনোয়ারা খাতুন। তবে মূল্যবান কাগজপত্র হারানোর বিষয়ে বিদায়ী প্রধান শিক্ষককে দায়ি করেছেন।

তবে তাঁ অভিযোগ অসত্য বলে দাবি করে সাবেক প্রধান শিক্ষক মোঃ শরিফুল ইসলাম বলেন, ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষককে সকল কিছু বুঝিয়ে দিয়ে স্বাক্ষর নিয়েছি। এদিকে রাজশাহী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোঃ সাদেকুল ইসলাম স্বপন। তাঁর বিষয়ে রয়েছে সার্টিফিকেট সহ- নানা ধরণের সমস্যা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধীক সিনিয়র শিক্ষক জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিভিন্ন হ-য-ব-র-ল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সার্টিফিকেট কিনে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ নেওয়া স্কুল গুলোর মধ্যে অন্যত্তম রাণীনগর নৈশ উচ্চ বিদ্যালয় ও রাজশাহী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়। এই দুই স্কুলে ১১জন শিক্ষক কর্মচারীর নিয়োগ দিয়েছেন রাসিক (২৪ নং ওয়ার্ড), সাবেক আওয়ামী-লীগ সভাপতি এবং স্কুল কমিটির সভাপতি মোঃ আব্দুল করিম।

তবে তার দেওয়া নিয়োগকৃতদের শিক্ষকদের সার্টিফিকেটে ত্রুটি রয়েছে বলে অভিযোগ ওঠেছে। শুধু তাই নয় মোঃ আব্দুল করিম মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দিতে প্রধান শিক্ষক মোঃ শরিফু ইসলাম-সহ নিয়োগ কমিটির সদস্যদের মারপিট করেছেন এই মর্মে থানায় জিডিও রয়েছে। তার দেওয়া নিয়োগকৃত শিক্ষকরা অধিকাংশই দূর্বল সার্টিফিকেটের মালিক। আওয়ামী-লীগ সরকারের আমলে শিক্ষক কর্মচারী নিয়োগে অন্যান্য স্কুলের চিত্র ভিন্ন হবে না, বলেও দাবি করেছেন একাধীক সিনিয়র শিক্ষকগণ।

অগ্রণী বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ সাইফুল হক বলেন, একটি আদর্শ জাতি গঠনে প্রাথমিক শিক্ষা সবচেয়ে  গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু প্রধান শিক্ষক না থাকায় সুষ্ঠু পাঠদানে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে এবং শিক্ষার প্রথম ধাপটি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

পবা উপজেলার ভালাম ভবানীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নফুরা খাতুন জানান, প্রধান শিক্ষক না থাকায় শিক্ষক সংকট দেখা দিয়েছে এবং তাঁদের সীমিত ক্ষমতার কারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। অভিভাবকরাও এই পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

গোদাগাড়ীর আজমল হক বলেন, আমার ছেলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে, কিন্তু স্কুলে প্রধান শিক্ষক না থাকায় পড়াশোনার মান কমে গেছে। আমরা অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন। রাজশাহী জেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির আহ্ধসঢ়,বায়ক সাইফুল ইসলাম বলেন, প্রধান শিক্ষক একটি প্রতিষ্ঠানের অভিভাবক। ভারপ্রাপ্ত শিক্ষকরা সহকারী হওয়ায় প্রশাসনিক জটিলতা দেখা দেয় এবং চেইন অব কমান্ড নষ্ট হয়। ২০১০ সালের পর থেকে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ হয়নি। ফলে সংকট আরও বেড়েছে। গুণগত মানসম্মত শিক্ষার জন্য প্রতিটি বিদ্যালয়ে পূর্ণকালীন প্রধান শিক্ষক থাকা অপরিহার্য।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. খালেদুজ্জামান বলেন, প্রধান শিক্ষক না থাকলে বিদ্যালয়ে শৃঙ্খলা থাকবে না, সঠিক পর্যবেক্ষণ হবে না এবং শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মেধার বিকাশ এবং নীতি- নৈতিকতা সম্পন্ন জাতি গঠনে বিরূপ প্রভাব ফেলবে।

রাজশাহী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এ কে এম আনোয়ার হোসেন জানান, প্রধান শিক্ষকের সংকট দেশব্যাপী। রাজশাহীর বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি শিক্ষা কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য। এই অচলাবস্থা নিরসনে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে রাজশাহীর প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা আরও বড় সংকটে পড়তে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।


 

সম্পাদকীয় :

প্রকাশক ও সম্পাদক : মোঃ গোলাম মাওলা শাওন
মোবাইল : ০১৭১১-০০৬২১৪

অফিস :

প্রধান কার্যালয় : ৩১/১ শরীফ কমপ্লেক্স ৫ম তলা পুরানা পল্টন ঢাকা ১০০০

মোবাইল : ০১৯৯৯-৯৫৩৯৭০

ই-মেইল : [email protected],  [email protected]