
নিজস্ব প্রতিবেদক
মোসাঃ মিতু খাতুন (রাবি): বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানসিক সমস্যা এক ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, যা আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি, পড়াশোনায় অনীহা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং এমনকি আত্মহননের প্রবণতা পর্যন্ত সৃষ্টি করছে।
একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যায় আক্রান্ত হলেও বেশিরভাগ শিক্ষার্থী তা প্রকাশ করে না কিংবা যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণে এগিয়ে আসে না। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ইন্টার্নি কো-অর্ডিনেটর মোঃ মেহেদী হাসান (মনোবিজ্ঞানী) এর দেওয়া তথ্যমতে, জুলাই ২০২৪ থেকে জুন ২০২৫ পর্যন্ত এক বছরে মোট ৫৪৯ জন শিক্ষার্থী কাউন্সেলিং সেবার জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসেছেন। এর মধ্যে ২৬৭ জন ছেলে এবং ২৫৮ জন মেয়ে। এই সময়ে মোট ২৫৮৬টি সেশন পরিচালিত হয়েছে, যার মধ্যে ৫০৩টি ছিল ব্যক্তিগত সেশন। গড়ে প্রতিদিন ১২-১৫ জন শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে কাউন্সেলিং দেওয়া হচ্ছে। কেন্দ্রটির অভিমত অনুযায়ী, প্রায় ৫০% সমস্যা কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে সমাধান হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শিক্ষার্থীদের মানসিক সমস্যার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: পড়াশোনার চাপ: পরীক্ষার ফলাফল, ভালো গ্রেড অর্জন এবং উচ্চশিক্ষার চাপ অনেক শিক্ষার্থীকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। ক্যারিয়ার অনিশ্চয়তা: ভবিষ্যৎ কর্মজীবন নিয়ে উদ্বেগ, চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতা এবং কাঙিত ক্যারিয়ার গড়তে না পারার ভয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করে। আর্থিক সংকট: পারিবারিক আর্থিক চাপ এবং ব্যক্তিগত খরচের যোগান দিতে না পারাও অনেক শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। পারিবারিক জটিলতা: পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সমস্যা, পারিবারিক বিচ্ছেদ বা অন্যান্য পারিবারিক কারণে শিক্ষার্থীরা মানসিক চাপে ভোগে।
মাদকাসক্তি: ক্যাম্পাসে মাদকের সহজলভ্যতা এবং এর ব্যবহার শিক্ষার্থীদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে। রিলেশনশিপ সমস্যা: প্রেমঘটিত সমস্যা, ব্রেকআপ বা সম্পর্কের টানাপোড়েন অনেক শিক্ষার্থীর জন্য মানসিক যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার: অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম, সাইবারবুলিং এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের অন্যের সাথে তুলনা করাও শিক্ষার্থীদের মধ্যে উদ্বেগ ও বিষন্নতা বাড়াচ্ছে। পরিবেশগত প্রভাব: নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে সমস্যা, হোস্টেলের জীবনযাপন বা বন্ধুত্বের অভাবেও শিক্ষার্থীরা একাকীত্ব ও হতাশার শিকার হয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি ও বিশ্ববিদ্যালয় মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের পরিচালক প্রফেসর ড. মোহা. এনামুল হক এক বক্তব্যে বলেন, ক্যারিয়ার অনিশ্চয়তা, মাদকাসক্তি, পারিবারিক সমস্যা, হীনমন্যতা, নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়ানো এবং হতাশা এসব কারণেই শিক্ষার্থীরা মানসিক সমস্যায় ভুগছে। মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা কর্মসূচি: বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিতভাবে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মশালা, সেমিনার এবং সচেতনতামূলক প্রচারাভিযান পরিচালনা করা জরুরি। কাউন্সেলিং সেবা সম্প্রসারণ: মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের পরিসর বৃদ্ধি করে আরও বেশি মনোবিজ্ঞানী ও কাউন্সেলর নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন, যাতে সকল শিক্ষার্থী সহজে সেবা গ্রহণ করতে পারে। শিক্ষক ও পরিবারের সহযোগিতা: শিক্ষক এবং অভিভাবকদের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি আরও সংবেদনশীল হওয়া উচিত। তাদের পাশে থেকে মানসিক সমর্থন ও সাহস যোগানো প্রয়োজন।
সহায়ক পরিবেশ তৈরি: ক্যাম্পাসে পড়াশোনার চাপের পাশাপাশি খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, এবং অন্যান্য সহশিক্ষা কার্যক্রমের সুযোগ বাড়িয়ে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বস্তির একটি পরিবেশ তৈরি করা যেতে পারে। দ্রুত শনাক্তকরণ ও হস্তক্ষেপ: প্রাথমিক পর্যায়ে মানসিক সমস্যার লক্ষণগুলো শনাক্ত করে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা গেলে অনেক বড় বিপদ এড়ানো সম্ভব। শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, শিক্ষক, পরিবার এবং সমাজের সকল স্তরের মানুষকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। একটি সুস্থ মানসিক পরিবেশই একজন শিক্ষার্থীকে তার শিক্ষাজীবনে সফল হতে এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে পারে।