
ফাহাদ মোল্লা:
মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার রাঢ়িখাল ইউনিয়নের কবুতরখোলা গ্রাম। গ্রামের বড় মসজিদের সামনে রোববার (৮ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় পড়ে থাকা একটি কার্টনে প্রথমে সাধারণই মনে হয়েছিল স্থানীয়দের কাছে। কিন্তু বাক্সটি খুলতেই ভেতরে উঁকি মারে অকল্পনীয় এক দৃশ্য- পলিথিনে মোড়ানো, ডায়াপার পরা এক ছেলে নবজাতকের নিথর দেহ। ক্ষুদ্র সেই শরীরটি তখনও যেন বলছিল, “আমাকে বাঁচতে দাও।
পুলিশের প্রাথমিক ধারণা, শিশুটির জন্ম মাত্র কয়েক দিনের। পৃথিবীতে আসার আনন্দ সে বুঝতেই পারেনি, এর আগেই তাকে পাড়ি জমাতে হলো মৃত্যুর অন্ধকারে। জন্ম যে সাধারণত আশীর্বাদ, আনন্দ আর স্বপ্নের সূচনা এই শিশুটির জন্য তা হয়ে উঠল মৃত্যুর সমার্থক।
শ্রীনগর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নাজমুল হুদা খান জানান, শিশুটির মরদেহ থানায় রাখা হয়েছে। তিনি বলেন আমরা ঘটনার রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করছি। যদি কোনোভাবে পরিবারের সন্ধান না মেলে, তবে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম বা প্রশাসনের উদ্যোগে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফনের ব্যবস্থা করা হবে।
এই ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনা নয়, বরং আমাদের সমাজে বাড়তে থাকা নৈতিক অবক্ষয়ের নির্মম প্রমাণ। একটি নবজাতক পৃথিবীর আলো দেখার সঙ্গে সঙ্গেই যদি ‘বোঝা’ হয়ে যায়, তবে প্রশ্ন জাগে- আমরা কোন পথে চলছি? এখানে দায় শুধু ওই অচেনা মা-বাবার নয়, দায় গোটা সমাজের। কারণ, এমন একটি পরিবেশ আমরা গড়ে তুলেছি যেখানে মানুষ সন্তান জন্ম দিয়েও তাকে গ্রহণ করার সাহস পায় না। সামাজিক লজ্জা, দারিদ্র্য, পারিবারিক চাপ- সব মিলিয়ে নিরীহ শিশুটিকে পৃথিবী থেকে বিদায় জানাতে হয় তার জীবনের শুরুতেই।
কার্টনের ভেতরে শুয়ে থাকা এই নবজাতক যেন আমাদের বিবেকের সামনে প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিল। আমরা কি এতটাই অমানবিক হয়ে গেছি যে, নিরীহ একটি প্রাণের ঠাঁই নেই আমাদের হৃদয়ে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের ঘটনা কেবল অপরাধ নয়, বরং মানবিকতার মৃত্যু। প্রতিটি শিশুর জন্মই একটি নতুন ভবিষ্যতের সম্ভাবনা। অথচ আমরা সেই ভবিষ্যতকে কার্টনের ভেতর লুকিয়ে দিচ্ছি, পরিত্যাগ করছি। এমন ঘটনা রোধে সচেতনতা, সামাজিক সহমর্মিতা এবং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ জরুরি। অবাঞ্ছিত গর্ভধারণের ক্ষেত্রে নিরাপদ ও আইনি সমাধান প্রক্রিয়া, সামাজিক সহায়তা এবং পরামর্শকেন্দ্র স্থাপন জরুরি। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মানবিকতার চর্চা—যাতে কোনো মা নিজের সন্তানকে সমাজের ভয়ে বা অসহায়তার কারণে কার্টনে ভরে ফেলে না যায়। কবুতরখোলা গ্রামের সেই কার্টন কেবল একটি শিশুর নিথর দেহ বহন করেনি, বহন করেছে আমাদের নৈতিকতার ক্ষয়িষ্ণু চিত্র। এই মৃত্যুর দায় শুধু অজানা কারও নয়, আমাদের সবার। আজ যদি আমরা জেগে না উঠি, তবে হয়তো কাল আরও কত নবজাতক এভাবেই কার্টনের অন্ধকারে হারিয়ে যাবে।