
সাজেল আহমেদ
গনতন্ত্রের মাতৃভূমি নামে খ্যাত মাল্টি কালচারাল ও মাল্টিমিডিয়া এবং মাল্টি ন্যাশনালের বৃটেনের বাংলাদেশের মহাণ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, ইউকে বিডি টিভির উপদেষ্টা, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি, ৬০ এর দশকের আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের সাবেক ছাত্রনেতা।
৭১ এর বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম সুলতান মাহমুদ শরীফ এর ইসহালে সওয়াব উপলক্ষে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ ও বৃটেনের বাংলাদেশ কমিউনিটির পক্ষ থেকে গত শুক্রবার ২৯ শে আগষ্ট সেন্ট্রাল লন্ডনের ব্রিকলেন জামে মসজিদে বাদ জুম্মা বিপুল সংখ্যক প্রবাসীদের উপস্থিতিতে এক দোয়া ও মিলাদ মাহফিল ও সিন্নী বিতরণ করা হয়েছে। দোয়া পরিচালনা করেন ব্রিকলেন জামে মসজিদে ঈমাম ও খতীব মুফতি মাওলানা নজরুল ইসলাম।
গত ২৪ আগস্ট, রোববার দুপুর ১২ ঘটিকায় পূর্ব লন্ডনের আলতাব আলী পার্কস্থ শহীদ মিনারে সুলতান মাহমুদ শরীফের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন ব্রিটেন প্রবাসী বাঙালিরা। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাজিদুর রহমান ফারুকের পরিচালনায় বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও কমিউনিটি সংগঠনের পক্ষ থেকে এবং প্রয়াতের মরদেহে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনার পক্ষ থেকে ও ফুল দিয়ে এই শ্রদ্ধা জানানো হয়।
সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মীসহ বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ এর শেষ বিদায়ে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় সিক্ত হলেন- সুলতান শরীফ। বর্তমানে লন্ডনে বসবাসরত সদ্য সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের চার মন্ত্রী আব্দুর রহমান, শফিকুর রহমান চৌধুরী, স ম রেজাউল করিম ও খালেদ মাহমুদ এবং সিলেট সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, সাবেক এম পি হাবিবুর রহমান হাবিবকে সাথে নিয়ে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আলহাজ্ব জালাল উদ্দীন, সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাজিদুর রহমান ফারুক ও সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল আহাদ চৌধুরী সহ সংগঠনের অন্যান্য সিনিয়র নেতৃবৃন্দ আনুষ্ঠানিক শ্রদ্ধা জানানোর পর একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, যুক্তরাজ্য যুবলীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিকলীগ, কৃষকলীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ সহ বিভিন্ন সহযোগী ও অংগ সংগঠন।
বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ সেন্টার এবং বিলেতের দুই প্রাচীনতম সংবাদ মাধ্যম সত্যবাণী ও জনমত পত্রিকা, চ্যানেল এস ও ইউকে বিডি টিভির প্রতিনিধি ছাড়া ও বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ একে একে মরদেহে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান বাঙালীর মুক্তি সংগ্রাম সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী প্রবীন রাজনীতিক ও কমিউনিটি ব্যাক্তিত্ব সুলতান শরীফের প্রতি।
এসময় প্রয়াত সুলতান শরীফ ও মুক্তিযুদ্ধের বিদেশী সংগঠক প্রয়াত ব্যারিষ্টার নোরা শরীফের সন্তান ফওজিয়া শরীফ ও তার মেয়ে নিরবে দাড়িয়েছিলেন মরদেহের পাশে।
শ্রদ্ধা প্রদর্শন শেষে বৃটেনের বসবাসকারী মুক্তিযোদ্ধারা রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রুপে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা দেওয়ান গৌস সুলতান, লোকমান হোসেইন, আবু মুসা হাসান, হিমাংশু গুস্বামী, ফয়জুর রহমান খান, এনামুল হক, আবু তাহের, শহীদুল ইসলাম বাবলু, আমির খান ও আলাউদ্দিন সহ প্রমুখ।
শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা প্রদর্শন শেষে নামাজে জানাজার উদ্দেশ্যে সুলতান শরীফের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় ব্রিকলেন জামে মসজিদে। মসজিদের ইমাম ও খতীব মুফতি মাওলানা নজরুল ইসলাম এর নেতৃত্বে বাদ যোহর নামাজে জানাজা শেষে সুলতান শরীফের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মী সাবেক মন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী তাঁর প্রয়াত নেতা সুলতান শরীফের আত্মার মাগফেরাতের জন্য সকলের কাছে দোয়া প্রার্থনা করেন। জানাজায় মসজিদটিতে শুধু সেন্ট্রাল লন্ডন নয় বৃটেনের প্রতিটি শহর থেকে আগত মানুষের উপস্থিতিতে কানায় কানায় পরিপূর্ণ ছিল।
গত মঙ্গলবার ২৬ শে আগষ্ট স্ত্রী নোরা শরিফের কাছে আগে থেকে কিনে রাখা কবরস্থানে চীরনিদ্রায় শায়িত করা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ব্রিটেনে জনমত গঠন ও সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সুলতান মাহমুদ শরীফকে।
উল্লেখ্য, গত ২৩ আগস্ট, শনিবার ভোর ৩টার সময় লন্ডনের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। দীর্ঘদিন শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন তিনি। স্ত্রীকে আগেই হারানো এ প্রবীণ নেতা রেখে গেছেন দুই কন্যা, নাতি-নাতনি, আত্মীয়স্বজন ও অসংখ্য রাজনৈতিক সহকর্মী, বন্ধুবান্ধব সহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
মরহুমের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি বঙ্গবন্ধুর কন্যা জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা আজ এক শোক বিবৃতিতে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা সুলতান মাহমুদ শরীফের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। একইসাথে বিবৃতিতে তিনি মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন। এছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক ও বৃটেনের বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও ইতিমধ্যে শোক প্রকাশ করেছেন।
এদিকে, ইউকে বিডি টিভির চেয়ারম্যান কমিউনিটি ব্যাক্তিত্ব মোহাম্মদ মকিস মনসুর ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর ইঞ্জিনিয়ার খায়রুল আলম লিংকন সহ ইউকে বিডি টিভির পরিচালনা পর্ষদ এর পক্ষ থেকে সকল ডিরেক্টরবৃন্দ ইউকে বিডি টিভির অন্যতম উপদেষ্টা ও ৭১এর বীর মুক্তিযোদ্ধা বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ সুলতান মাহমুদ শরীফ এর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ ও শোকাবহ পরিবারবর্গ এর প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। শোকবার্তায় ইউকে বিডি টিভির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মকিস মনসুর বলেন প্রবাসে রাজনীতি এবং কমিউনিটির স্বার্থে তিনি আজীবন নিষ্টা ও নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন।
তিনি তাঁর ভাল কাজের জন্য মানুষের মধ্যে আজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। এ মৃত্যু শুধু একজন ব্যক্তির প্রস্থান নয়, এটি এক যুগের সমাপ্তি। প্রবাসে বঙ্গবন্ধুর সৈনিক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি যে ত্যাগ, যে সংগ্রাম ও যে সাহসিকতা দেখিয়েছিলেন, তা প্রবাসী বাঙালির ইতিহাসে চিরঅম্লান হয়ে থাকবে। তাঁর জীবন ছিল বাংলাদেশ ও আওয়ামী লীগের জন্য এক অবিরাম নিবেদন। আজ আমরা হারালাম এক অকৃত্রিম অভিভাবক, এক অদম্য প্রেরণার উৎস এবং প্রবাসী বাঙালি জাতির এক মহান স্তম্ভ।
তাঁর চলে যাওয়া আমাদের হৃদয়ে এমন এক শূন্যতা সৃষ্টি করেছে, যা কখনো পূরণ হওয়ার নয়। তাঁর নেতৃত্ব, ভালোবাসা ও নিঃস্বার্থ ত্যাগ আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপে অনুপস্থিতির বেদনাকে স্মরণ করিয়ে দেবে। যুক্তরাজ্যের মাটিতে থেকেও তিনি সবসময় বাংলার মানুষের কথা ভেবেছেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুকে লালন করেছেন, আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে প্রবাসে ছড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর নেতৃত্বে অসংখ্য আন্দোলন-সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালি একত্রিত হয়েছে, পেয়েছে দিকনির্দেশনা।
উল্লেখ্য যে, সুলতান মাহমুদ শরীফ ১৯৪১ সালের ২৬ শে জানুয়ারী বরিশাল জেলার কতোয়ালী থানার চানপুরা ইউনিয়নের সারুখালী গ্রামে এক সম্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি স্কুল জীবনেই ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হোন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ইকবাল হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬২-৬৩ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন, হোসেন সোহরাওয়ার্দীর মুক্তি আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি আন্দোলন, শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাতিলের আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন তিনি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় লন্ডন থেকে প্রবাসী বাঙালিরা বঙ্গবন্ধু কে মুক্ত করার জন্য কিউসি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। স্যার টমাস কিউসি উইলিয়ামকে পাঠাতে সুলতান মাহমুদ শরীফ ও তার স্ত্রী আইরিশ বংশোদ্ভূত ব্যারিষ্টার নোরা শরীফের ভূমিকা ছিলো অনন্য।
বীর মুক্তিযোদ্ধা সুলতান মুহাম্মদ শরীফ বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ প্রতিষ্ঠায় শেখ ফজলুল হক মণির সঙ্গে অন্যতম সংগঠক হিসেবে এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার প্রতিবাদে তিনি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আন্দোলন গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৩ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের সময় লন্ডনে একজন ছাত্রনেতা হিসেবে সামনের কাতারে ছিলেন তিনি।
১৯৬৯ সালে লন্ডন মহানগর আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক এর দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের একজন দক্ষ সংগঠক হিসেবে তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য। যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাঙালিদের সাথে নিয়ে মহাণ মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশ্বজনমত গড়ে তুলতে আরও অনেকের সঙ্গে তিনি ছিলেন সামনের কাতারে।
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে লন্ডন থেকে বাংলাদেশে গিয়েও স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে তার কর্মকান্ডের জন্য স্বীকৃতিস্বরূপ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০২১ সালে তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।
১৯৭২ সালের নভেম্বর মাসে যুবলীগের প্রতিষ্ঠা হলে শেখ ফজলুল হক মণি যুবলীগের চেয়ারম্যান হন, সুলতান শরীফ সেই কমিটির সেক্রেটারিয়েটের সদস্য ছিলেন। ১৯৭৩ সালে যুবলীগের পূর্নাঙ্গ কমিটিতে তিনি প্রেসিডিয়াম সদস্যেরও দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত প্রিয় ও কাছের লোক ছিলেন সুলতান মাহমুদ শরীফ।