মাসুদ রানা রাব্বানী, রাজশাহী: স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ বিভিন্ন মেয়াদে দেশ শাসন করলেও রাজশাহী-২ (সদর) আসনটিতে কখনোই দলটির কোনো প্রার্থী বিজয়ী হতে পারেননি। গুরুত্বপূর্ণ এই আসনটিতে বরাবরই বিএনপির প্রার্থীরা জিতে সংসদে গেছেন। এ কারণে রাজশাহী মহানগর আসনটিকে ‘বিএনপির দুর্গ’ বলা হয়ে থাকে। শেষের তিনবার জোটগতভাবে ভোট করে ওয়াকার্স পার্টির প্রার্থী ফজলে হোসেন বাদশা এমপি হয়েছিলেন প্রায় বিনা ভোটে। এই আসনে জামায়াতে ইসলামীর সাংগঠনিক অবস্থান শক্ত হলেও তাদেরও কোনো প্রার্থী অতীতের কোনো নির্বাচনে জিততে পারেননি। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা আগামী সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক দলীয় ও সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার করেছেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ও তাদের অন্যতম শরিক দল বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির নেতাকর্মীদের কোনো সাংগঠনিক তৎপরতা এখনো রাজশাহী মহানগর এলাকায় নেই।
জানা গেছে, রাজশাহী বিএনপির সবচেয়ে জনপ্রিয় মুখ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু গত ৫ আগস্টের পর থেকে নির্বাচনমুখী তৎপরতা জোরদার করেছেন। মিনু সর্বস্তরের বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে দলীয়, সাংগঠনিক ও বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডে অংশ নিচ্ছেন নিয়মিত। দলীয় নেতাকর্মীরা রাজশাহী-২ আসনে মিনুকে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী হিসাবে তুলে ধরে গণসংযোগ শুরু করেছেন। মিনু তার স্বভাবসুলভ অভ্যাস মতো হেঁটে হেঁটে নগরীর সাধারণ মানুষের সঙ্গে কুশল বিনিময় করছেন। যোগ দিচ্ছেন বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে। আগামী নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসাবে মানুষের দোয়া চাইছেন।
বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে রাজশাহী মহানগর বিএনপির নতুন আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হলে মিনুপন্থিরা সবাই বাদ পড়েন। এর বদলে রাজশাহী মহানগর বিএনপিতে মিনু বিরোধীদের কমিটিতে পদ-পদবি দেওয়া হয়। সেই থেকে মিনু ও ঘনিষ্ঠ অনুসারী নেতাকর্মীদের অনেকটাই কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে বলে দলের নেতাকর্মীদের একাংশের অভিযোগ। এ কারণে সবসময় রাজশাহীতে বিভিন্ন দলীয় কর্মসূচিতে মিনু দলের প্রধান মুখ হিসাবে উপস্থিত থাকলেও গত এক বছরে মহানগর বিএনপির যে কোনো সাংগঠনিক কর্মকান্ডে তিনি উপেক্ষিত থাকছেন। এ নিয়ে মহানগর বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের মাঝে চাপা অসন্তোষ রয়েছে। তবে এখনো বিভিন্ন দলীয় কর্মসূচিতে মিনুর সঙ্গেই দেখা যায় মহানগর বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের অধিকাংশ নেতাকর্মীকে। গত ১০ নভেম্বর মিনু নগরীতে একটি শোডাউন করেন যাতে দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীর অংশগ্রহণ দেখা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য শফিকুল আলম সমাপ্ত বলেন, মিজানুর রহমান মিনু শুধু দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝেই নয়, রাজশাহীর সর্বস্তরের মানুষের কাছে একটি জনপ্রিয় নাম। রাজশাহীর উন্নয়নের রূপকার তিনি। তার কাছে অবলীলায় দলের নেতাকর্মীরা যেমন যেতে পারেন তেমনি রাজশাহীর দলমত নির্বিশেষে সবস্তরের মানুষ যেতে পারেন। কথা বলতে পারেন। এত বড় নেতা অথচ নিরহংকার। এটাই মিনুকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে। আগামী নির্বাচনে দলের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসাবে মিনুকে সামনে রেখে নেতাকর্মীরা মাঠে কাজ করছেন।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, মিনু একটানা তিন মেয়াদে ১৭ বছর রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র ছিলেন। ২০০১ সালে রাজশাহী-২ আসনে বিএনপির প্রার্থী হিসাবে রেকর্ড সংখ্যক ভোট পেয়ে প্রথমবার সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন। বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও যুগ্ম মহাসচিব ছিলেন বিভিন্ন মেয়াদে। বর্তমানে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা।
প্রার্থী হওয়া প্রসঙ্গে মিজানুর রহমান মিনু বলেন, রাজশাহীর দলীয় নেতাকর্মী ছাড়াও সাধারণ মানুষ মনে করেন স্বৈরাচারমুক্ত পরিবেশে আগামীতে যে নির্বাচন হবে সেখানে দেশপ্রেমিক ও ত্যাগী নেতারাই নির্বাচিত হয়ে সংসদে যাবেন। আমি সবসময় সাধারণ মানুষের সঙ্গে থেকেছি। সবসময় দলীয় নেতাকর্মীদের পাশে থেকেছি। রাজশাহী তথা উত্তরাঞ্চলজুড়ে জাতীয়তাবাদী শক্তিকে শক্তিশালী করেছি। দল নিশ্চয় আমার এসব অবদানকে মূল্যায়ন করবে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ৩১ দফার আলোকে একটি সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ গড়তে আমরা কাজ করছি।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী রাজশাহী-২ আসনে এখনো দলীয় প্রার্থী ঠিক না করলেও দলটির নেতাকর্মীদের সাংগঠনিক তৎপরতা চোখে পড়ার মতো। আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জামায়াতের নেতাকর্মীরা নগরীর থানা, ওয়ার্ড ও মহল্লা পর্যায়ে নিবিড় সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। দলবেঁধে করছেন গণসংযোগ। এছাড়া মসজিদ ও মাদ্রাসায় গিয়ে বিভিন্ন দোয়া মাহফিলে অংশগ্রহণ করছেন। গত ১৮ জানুয়ারি রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদ্রাসা মাঠে এক বিশাল সমাবেশ করেছে জামায়াতে ইসলামী। ওইদিন জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান রাজশাহীর চিকিৎসক কমিউনিটি, নারী সমাজ ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পৃথক পৃথক সমাবেশে বক্তব্য দেন। তিনি আগামীতে কুরআনের আলোকে রাষ্ট্র ও সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে কাজ করার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্ধসঢ়;বান জানান।
আগামী নির্বাচনে রাজশাহী-২ আসনে জামায়াতের সম্ভাব্য প্রার্থী কে-এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী মহানগর জামায়াতের সেক্রেটারি এমাজ উদ্দিন মন্ডল বলেন, রাজশাহীতে এখন পর্যন্ত দুটি আসনে দলের সম্ভাব্য প্রার্থী ঠিক হয়েছে। কিন্তু রাজশাহী-২ আসনে হয়নি। এই আসনে প্রার্থী কে হবেন তা ঠিক করবেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। তবে রাজশাহীর সব আসনে দলীয়ভাবে নির্বাচন করার প্রস্তুতি শুরু করেছেন আমাদের দলের নেতাকর্মীরা। রাজশাহীর ৬টি আসন ছাড়াও রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও আমরা দলীয়ভাবে অংশগ্রহণ করব। এখন পর্যন্ত এমন সিদ্ধান্তই আছে।
এদিকে রাজশাহী-২ আসনে জাতীয় পার্টির সম্ভাব্য প্রার্থী দলটির ভাইস চেয়ারম্যান ও রাজশাহী মহানগর জাতীয় পার্টির আহ্ধসঢ়;বায়ক সাইফুল ইসলাম স্বপন বলেন, আমি রাজশাহী-২ আসনসহ একাধিক আসন থেকে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা ইতোমধ্যে তৃণমূল পর্যায়ে দলীয়ভাবে কার্যক্রম শুরু করেছেন।
উল্লেখ্য, রাজশাহী-২ আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ১৮ হাজার ১৩৮ জন। স্বাধীনতার পর রাজশাহীর এই আসনটিতে নির্বাচনে তিনবার বিএনপি, দুবার জাতীয় পার্টি, তিনবার ওয়ার্কার্স পার্টি, একবার জাসদ ও একবার স্বতন্ত্র প্রার্থী জিতে সংসদে গেছেন।