নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, সৎ নেতৃত্ব থেকে দেশ এখনো বঞ্চিত রয়ে গেছে। সৎ নেতৃত্ব ছাড়া মর্যাদাপূর্ণ জাতি গঠন সম্ভব নয়। তিনি বলেন, আল্লাহ আমাদের এই দেশ উপহার দিয়েছেন। সাথে খনিজ সম্পদসহ অনেক কিছু দিয়েছেন। কিন্তুসৎ নেতৃত্ব থেকে দেশ এখনো বঞ্চিত রয়ে গেছে। এই জায়গাটা পূরণ না হলে আমাদের জাতি সত্যিকার অর্থে মর্যাদাপূর্ণ জাতিতে পরিণত হতে পারবে না। তিনি বলেন, ২৪ সালের ৫ আগষ্টের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে ছিল দুঃশাসন আর দুর্নীতিতে পরিপূর্ণ।
২৭ ডিসেম্বর শুক্রবার যশোর জেলা ঈদগাহ মাঠে ঐতিহাসিক কর্মী সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমান এসব কথা বলেন। জেলা আমীর অধ্যাপক গোলাম রসুলের সভাপতিত্বে ও জেলা সেক্রেটারি মাওলানা আবু জাফর ও সহকারী সেক্রেটারি অধ্যাপক গোলাম কুদ্দুসের যৌথ সঞ্চালনায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মো. মোবারক হোসেন, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য মুহাদ্দিস আবদুল খালেক ও মাওলানা আজিজুর রহমান।
অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সদস্য ড. আবদুল মতিন, ড. আলমগীর বিশ্বাস, ঝিনাইদহ জেলা আমীর অধ্যাপক আলী আযম, চুয়াডাঙ্গা জেলা আমীর এডভোকেট রুহুল আমীন, মাগুরা জেলা আমীর এমবি বাকের, নড়াইল জেলা আমীর আতাউর রহমান বাচ্চু, সাতক্ষীরা জেলা আমীর, অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম। ডা. মোসলেহ উদ্দীন ফরিদ, শহীদ আব্দুল্লাহর বাবা আব্দুল জব্বার, যশোর জেলার নায়েবে আমীর মাওলানা হাবিবুর রহমান, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সহকারী সেক্রেটারি ড. আবদুল মান্নান, যশোর জেলা কর্মপরিষদ সদস্য এডভোকেট গাজী এনামুল হক, মাওলানা আরশাদুল আলম, কেশব উপজেলা আমীর অধ্যাপক মুক্তার আলী, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আব্দুল কাদের জেলাশহর শিবির সভাপতি মোস্তফা কামাল প্রমুখ।
এর আগে আব্দুল্লাহ আল মামুনের অর্থসহ কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে কর্মী সম্মেলনের সূচনা হয়। শহীদ আব্দুল্লাহর বাবা আবদুল জব্বার বলেন, আমার ছেলে ঢাকায় গুলি খেয়ে ১০০ দিন পর মারা গেছে। তিনি জামায়াতের কাছে দাবি করেন তার ছেলের রক্তের বিনিময়ে এই দেশে যেন আল্লাহর বিধান কায়েম হয়। ভারত থেকে নিয়ে এসে যেন শেখ হাসিনার বিচার করা হয়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি বলেন, সরকারি আইন মানতে গিয়ে যেন কোনো মানুষকে হত্যা করা না হয়। প্রয়োজনে বাড়ি ফিরে যাও।
মঞ্চে উঠেই জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা: শফিকুর রহমান সামনে উপস্থিত জনতাকে জিজ্ঞেস করেন, ৫ আগস্টের আগে কেমন ছিলেন? সমস্বরে সবাই জবাব দেন- ভাল ছিলাম না। তিনি যশোরবাসীর উদ্দেশে বলেন, ২৪ সালের ৫ আগষ্টের আগে দুঃশাসন ও দুর্নীতিতে দেশকে ডুবিয়ে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। এই দলটি যখনই ক্ষমতায় এসেছে, মানুষের ওপর প্রতিশোধ নিয়েছে। আওয়ামী লীগ আগের বারও জনগণের ওপর শোষণ-অত্যাচার করেছিল। কিন্তু এবারের অত্যাচার-জুলুম ছিল অন্য সময়ের চেয়ে হাজার গুণ বেশি।
তিনি বলেন, দেশে নতুনভাবে স্বাধীন হওয়ার প্রথম কৃতিত্ব মহান আল্লাহ তায়ালার। এরপর আমাদের গর্বের সন্তানদের। আমাদের সন্তানরা একটা দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল। রংপুরের আমাদের এক সন্তান আবু সাইদ বুক চিতিয়ে বলেছিল ‘বুকের ভেতর তুমুল ঝর, বুক পেতোিছ গুলি কর’। তারা ন্যায়সঙ্গত দাবিতে রাস্তায় নেমেছিল। ভেবেছিল তাকে পুলিশ গুলি করবে না। কিন্তু পুলিশ পর পর তিনটি গুলি করে তাকে শেষ করে দিলো।
আমীরে জামায়াত ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, যশোরে উন্নয়নের ছোঁয়া নাই। এটি কী বাংলাদেশের অংশ নয়? অবশ্যই বাংলাদেশের অংশ। কিন্তু তারা কেন তাদের ন্যায্য অধিকারটুকু পাচ্ছেন না। যশোর একটি অন্যতম বঞ্চিত এলাকা। এটি নাগরিক উন্নয়নের প্রাণকেন্দ্র হওয়ার কথা। কিন্তু কেন উন্নয়ন নাই। এটিও আওয়ামী লীগের একটি বৈষম্য। তিনি বলেন সুষম উন্নয়নের জন্য সুন্দর মন দরকার। তা না হলে বৈষম্য দূর করা সম্ভব নয়। যেখানেই যাই বৈষম্য দেখা যায়। সরকার বলেছিল তারা উন্নয়নের রাজপথে রোল মডেল। কিন্তু দেশবাসী দেখল, ফ্যাসিবাদের দোসররা দেশের সম্পদ চুরি করে বাইরে পাচার করে দেশকে ফোঁকলা করে দিয়েছে।
ডা. শফিকুর রহমান উল্লেখ করেন, আজ বাজারে আগুন। সিন্ডিকেট এখন হাতবদল হয়েছে। সরকার এখনো ভাঙতে পারেনি। একজন চাঁদাবাজ পালিয়েছে, আরেকজন চাঁদাবাজিতে লেগে গেছে। তিনি সামনের মানুষের কাছে প্রশ্ন রেখে বলেন, দেশ কি চাঁদাবাজ মুক্ত হয়েছে? মাঠ থেকে সমস্বরে জবাব আসে ‘না, না’।
পতিত ফ্যাসিবাদের আমলে জামায়াতে ইসলামী বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জামায়াতের নেতাদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। কার্যালয়গুলো তালা দেওয়া হয়েছে। নিবন্ধন কেড়ে নিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। হাজার লাখো মামলা দেওয়া হয়েছে। বিনয়ের সাথে একটা কথা বলতেই হবে। যারা বুকের রক্ত দিয়ে আমাদের একটি স্বাধীন দেশ দিয়ে গেল তাদের রক্তের সাথে যেন আমরা বেইমানি না করি। তারা বৈষম্যের বিরুদ্ধে, ঘুষখোরদের বিরুদ্ধে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আউয়াজ দিয়েছে। যদি বেঈমানি করেন তাহলে ঘৃণিত হবেন, নিন্দিত হবেন। আমরা আমাদের সকল সহকর্মীদের জানাই এসকল কাজে কেউ হাত বাড়াবেন না। কেউ চাঁদাবাজ হবেন না। কেউ ফুটপাতের দখলদার হবেন না। মামলা দিয়ে নিরীহ মানুষকে হয়রানি করবেন না।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, আজকে শিক্ষার্থীরা মাস্টার্স ডিগ্রী সার্টিফিকেট নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ায়। কাজ পায় না। তার একটা কারণ একটা গোষ্ঠির বাংলাদেশকে তাদের জমিদারি মনে করতো। তাদের আনুগত্য ছাড়া এদেশে কারো কোনো অধিকার ছিল না। এখন তারা বিদায় নিয়েছে। এখনতো আর এরকম থাকা উচিত নয়। কিন্তু এদেশে শিক্ষাব্যবস্থা নাই। ইনশাআল্লাহ আমরা এমন একটা শিক্ষা ব্যবস্থা করবো শিক্ষা জীবন শেষ হওয়ার সাথে সাথে তাদের হাতে কাজ দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এমন একিটা রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখে, যে রাষ্ট্রে আকাশ পাতাল ব্যবধান থাকবে না। কেউ গাছ তলায়, আবার কেউ ২০-তলায় থাকবে না। বিচার বিভাগের মেরুদ- সোজা করে দেওয়া হবে; যাতে রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকেও দ্বিতীয় চোখে না দেখে। ন্যায় বিচার নিশ্চিত হলে কাউকে অধিকার চাইতে হবে না। চাঁদাবাজ, দখলদার, ঘুষ-দুর্নীতি থাকবে না। আদালতের বৈষম্য দূর করা হবে। মানবিক বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ থাকবে না। দেশে কোনো সংখ্যা লঘু-সংখ্যা গুরু থাকবে না। ধর্ম নিয়ে বিভাজন বিভেদ চলবে না। এমন বৈষম্যহীন দেশ গড়ব, তাতে নারীরা প্রাপ্য অধিকার পেয়ে নিজেদের সম্মানিত বোধ করবেন।
উপস্থিত জনতার সামেন সুন্দর দেশ গড়ার অঙ্গিকার করে জামায়াতে ইসলামীর আমীর বলেন, এমন রাষ্ট্র গঠনে আপনাদের হাত মজবুত করতে হবে। দিল শক্ত করতে হবে। কদম চালু করতে হবে। দৃষ্টি প্রসারিত করতে হবে। দুঃশাসনমুক্ত দেশ গঠনে কাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখবেন এমন প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, আপনাদের দিকে মানুষ তাকিয়ে আছে। আপনাদের পারতেই হবে। আমরা যদি দেশের জন্য কাজ করি তহালে আপনাদের ভালবাসা চাইবো, সমর্থন এবং সহযোগিতা চাইবো। জাতীয় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমরা যেন আপনাদের পাশে পাই।
মোবারক হোসেন বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকার ১৬ বছর মানুষকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। বিশেষ করে ইসলামী আন্দোলনকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য সমস্ত পরিকল্পনা করেছে। আমাদের রাহাবারদের জুডিশিয়াল কিলিংয়ের মাধ্যমে হত্যা করেছে। ৫ শ’ মানুষকে শহীদ করেছে ২ হাজার মানুষকে গুম করেছে। ৫ আগস্টের পর মানুষ একটি সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের জন্য আশা করে আাছে। ফ্যাসিস্টরা টাকা পাচার করে দেশকে শেষ করে দিয়েছে। এই দেশকে বিনির্মাণ করতে প্রয়োজন ইনসাফপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা।
মুহাদ্দিস আবদুল খালেক বলেন, বাতিলের হুঙ্কারে আমাদের নেতারা কর্মীরা পিছুটান দেননি। দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়নি। হাত দিয়েছে, পা দিয়েছে যেমনটি জাতীয় কবি নজরুল বলেছেন ‘শের দেগা, নেহি দেগা আমামা’। এদেশকে ছেড়ে কোনদিন ছেড়ে যাবো না। আমাদের কেবলা কাবা, দিল্লি কিংবা ওয়াশিংটন নয়। কোরআনের শাসন আমাদের লক্ষ্য। ৫ আগস্ট ছিল আবাবিল পাখির ইতিহাস। মায়েরা ১০ মাসের শিশু নিয়ে রাস্তায় নেমেছে। সজাগ থাকতে হবে। দিল্লির বাবুরা উসকাসি দিচ্ছে। দলমত জাতিধর্ম নির্বিশেষে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
আজিজুর রহমান বলেন, যড়যন্ত্র শেষ হয়নি। দুটি মন্ত্রণালয় ছাই করে দিয়েছে। আমাদের দায়িত্ব বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, ৪৭ সালের, ৭১ সালের স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়েছে রাজনীতিবিদদের কারণে। যশোরকে অবহেলিত দাবি করে তিনি বলেন, সীমানা বৃদ্ধি করে যশোরকে সমৃদ্ধ করা দরকার। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য একসাথে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।
অধ্যাপক আলী আযম বলেন, আজকের সম্মেলন প্রমাণ করে নির্যাতন করে আদর্শ নির্মূল করা যায় না। চলুন জামায়াতের পতাকা তলে এসে দুর্নীতি এবং দখলদার মুক্ত দেশ গড়ি।
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক গোলাম রসুল বলেন, নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য যশোরের আপামর জনতা জামায়াতের সঙ্গেই থাকবে ইনশাআল্লাহ।