নিজস্ব প্রতিবেদক
জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে সংসদীয় আসনের পুনর্বিন্যাস ও ভোটার তালিকা হালনাগাদের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে যৌক্তিক সময় ও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার পক্ষে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলটির আমির শফিকুর রহমান বলেছেন, পরপর তিনটি জাতীয় নির্বাচনের নামে প্রহসন করায় দেশের মানুষ ভোটের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। নির্বাচনের প্রতি তাদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করতে হবে।
বুধবার ঢাকার মগবাজারের আল ফালাহ মিলনায়তনে কেন্দ্রীয় মজলিস শুরার অধিবেশনে তিনি একথা বলেন। কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরার এই বৈঠকের মূল মঞ্চে ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির মজিবুর রহমান, আবদুল্লাহ মো. তাহের, এমএম শামসুল ইসলাম এবং সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। সারা দেশ থেকে মজলিশে শুরার সদস্যরা বৈঠকে অংশ নেন।
আমিরে জামায়াত বলেন, যে যুব সমাজের মাধ্যমে দেশে পরিবর্তন এসেছে, তাদের সবাইকে অবশ্যই এবার ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন হচ্ছে বাড়ি বাড়ি গিয়ে এই ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা। এর জন্য যৌক্তিক যে সময় লাগবে সেটা অবশ্যই সরকারকে আমরা বিলম্বিত বা দীর্ঘায়িত সময় নয় যৌক্তিক সময়টাই দিতে চাই।
তবে দলের শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতার মুখে ভিন্ন কথা। গত ২৯ নভেম্বর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে দলের এক অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির মজিবুর রহমান বলেছিলেন, আমি বর্তমান উপদেষ্টা সরকারকে বলব- আপনারা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সংস্কার কাজ শেষ করে তারপরে নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। এটা যদি না হয়, তাহলে এ নির্বাচন তো নির্বাচন হবে না।
কিন্তু নায়েবে আমিরের বক্তব্যের দুই সপ্তাহের মাথায় জামায়াত আমির অন্তর্বর্তী সরকারকে যৌক্তিক সময় দেওয়ার কথা বললেন।
আমিরে জামায়াত বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্যতম মৌলিক দুটি বিষয়, অঙ্গাঙ্গিকভাবে জড়িত। একটি হচ্ছে- রাষ্ট্রের সব প্রাপ্ত বয়স্ক নাগরিককে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া।দ্বিতীয়টি হচ্ছে- অতীতের সরকার জুলুম করে বহু জায়গায় তৎকালীন বিরোধী দলে যারা ছিলেন তাদের এলাকাগুলোকে টার্গেট করে আসন সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছে, আসন বিন্যাসের নামে জুলুম করেছে। এগুলোকে পুনর্বিন্যাস করা লাগবে বিবেক এবং বাস্তবতার আলোকে।
তিনি বলেন, নিশ্চয় সবাই একমত হবেন, আওয়ামী লীগের সময়ে গত তিনটি নির্বাচনে ভোট বর্জন, ভোট না হওয়ার কারণে এদেশের মানুষ ভোটের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে ছিল। অসংখ্য তরুণ-তরুণীর বয়স হয়েছে ভোট দেওয়ার, কিন্তু ভোটার হওয়ার আগ্রহই তারা অন্তরে ধারণ করত না। পাশাপাশি এবারের এই যুদ্ধটা ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে শুধু দেশবাসী করে নাই, প্রবাসে আমাদের যে সমস্ত নাগরিকরা আছেন, তারা সবাই এক সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। আমরা তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাদেরকেও ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। প্রবাসীদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে দূতাবাসের মাধ্যমে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। শুধু ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য একজন নাগরিকের দেশে আসার প্রয়োজন নেই। বর্তমান আধুনিক প্রযুক্তির যুগে এখানে থেকেই তা সম্ভব। আমরা এও দাবি জানাই, তাদেরকে (প্রবাসীদের) যেন ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে আগামী নির্বাচন সম্পন্ন করা হয়।
সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দল জামায়াত
পতিত শেখ হাসিনার সরকারের আমলে জামায়াতে ইসলামী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মন্তব্য করে আমিরে জামায়াত বলেন, এত ক্ষতি অন্য কোনো দলের হয়নি। তিনি আরও বলেন, আমরা এ পর্যন্ত সারা দেশে পাঁচ শতের অধিক সহকর্মীকে হারিয়েছি। হাজার হাজার মামলা দিয়ে লাখ লাখ মানুষকে জেলে নেওয়া হয়েছে। কার্যত আমাদের বাড়িঘরই জেলে পরিণত হয়েছিল। জেলের ভেতরেও জেল, বাইরেও জেল। গোটা দেশটাকেই তারা একটা কারাগারে পরিণত করেছিল।
বক্তব্যে আমিরে জামায়াত বলেন, ৫ আগস্টের গণ-আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের, ২০০৯ সালে পিলখানায় শহীদ ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা এবং ‘বিচারিক হত্যার’ শিকার জামায়াতের সাবেক দুই আমিরসহ ১১ নেতাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন।
পিলখানা হত্যাযজ্ঞের পরের আঘাতটা দেওয়া হয়ে ছিল জামায়াতের ওপর-এ মন্তব্য করে আমিরে জামায়াত বলেন, দুজন সাবেক আমিরে জামায়াত অধ্যাপক গোলাম আযম, মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীসহ আমাদের ১১ জন্য সহকর্মীকে নির্মমভাবে বিচারের নামে প্রহসন চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আমরা এর প্রতিবাদ তখনো করেছি এবং এখনো করছি।
আমিরে জামায়াত বলেন, ২০১৩ সালে আমরা লক্ষ করেছি, শাহবাগের কেন্দ্রস্থলে আসর বসিয়ে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হয়েছিল। তখন দুটি সরকার প্যারালাল (সমান্তরাল) চলছিল। একটা সরকার ছিল সংসদকেন্দ্রিক, আরেকটা সরকার ছিল শাহবাগকেন্দ্রিক। শাহবাগের সরকার সংসদের সরকারের চাইতে ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছিল। তাদের কথায় জাতীয় পতাকা উঠত এবং নামত। জাতি বিস্ময়করভাবে এসব বিশৃঙ্খলা লক্ষ করেছে। এসব ট্রমা নিয়ে এ জাতি কোনো রকমে বেঁচেছিল এবং প্রতিটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল।
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের উল্লেখ করে আমিরে জামায়াত বলেন, সাড়ে ১৫ বছরের এই জগদ্দল পাথর আমাদের সন্তানতুল্য ছাত্র-ছাত্রী, যুবসমাজের মাধ্যমে গত ৫ আগস্ট সরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এই সরিয়ে দেওয়াও খুব সুখের ছিল না। কমবেশি দুই হাজার আদমসন্তানকে নির্মমভাবে খুন করা হয়েছে। তাদের সীমাহীন ত্যাগের বিনিময়ে আজকের এই বাংলাদেশ, নতুন বাংলাদেশ।
এ জাতিকে শহীদদের রক্তের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে এবং ঋণ পরিশোধের প্রতি যত্নশীল হতে হবে বলে মন্তব্য করেন জামায়াতের আমির।
দোসররা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে
পতিত স্বৈরাচার ও তাদের দোসররা দেশে-বিদেশে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে বলে মন্তব্য করেন আমিরে জামায়াত বলেন, দেশ যখন পরিবর্তনের ইতিবাচক ধারায় আছে, তখন দেশকে অশান্ত করার জন্য পতিত স্বৈরাচার এবং তাদের দোসররা দেশে-বিদেশে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। তারা অনেকগুলো দুর্ঘটনা ঘটিয়ে এ সমাজকে অস্থিতিশীল করতে চায়। বাংলাদেশের বিচক্ষণ দেশপ্রেমিক জনতা তাদের ফাঁদ বুঝতে পেরে তাদের ব্যর্থ করে দিয়েছে।
সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারের পরিচালনায় মজলিশে শুরার বার্ষিক অধিবেশনে নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান, সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের ও আ ন ম শামসুল ইসলামসহ কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ ও সারা দেশের মজলিশে শুরার সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।