মাসুদ রানা রাব্বানী, রাজশাহী: রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক রূপালী ব্যাংকের রাজশাহী কর্পোরেট শাখার শাখা প্রধান সোয়াইবুর রহমান খান বঙ্গবন্ধু পরিষদের রাজশাহী আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি, বিগত কমিটির সাধারণ সম্পাদক। ছাত্রজীবনেও ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতা। নিজের রাজনৈতিক পরিচয়কে হাতিয়ার বানিয়ে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে গত ১৫ বছর ধরে দেখিয়েছেন দাপট, করেছেন বদলি ও পদোন্নতি বাণিজ্য, নিয়েছেন অনৈতিক সুবিধা। শুধু তাই নয়, একটি সিন্ডিকেট গড়ে নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিদেরও দিয়েছেন বিশেষ সুবিধা। সোয়াইবুর রহমান খানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামীপন্থী সিন্ডিকেট ব্যাংকটিতে এখনও দাপট দেখাচ্ছেন। ফলে এসব কর্মকান্ডে অতিষ্ঠ হয়ে বৈষম্যের শিকার সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রূপালী ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান নজরুল হুদা বরাবর অভিযোগ দেন। সেই অভিযোগের প্রেক্ষিতে সম্প্রতি সোয়াইবুর রহমান খানের বিরুদ্ধে রূপালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশনায় রাজশাহী বিভাগীয় প্রধান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) তানভীর হাসনাইন মইনের নেতৃত্বে তদন্ত চলছে। দলীয় প্রভাব খাটিয়ে বদলি ও পদোন্নতি বাণিজ্য, সিন্ডিকেট গড়ে শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকান্ড, অনিয়ম- দুর্নীতিসহ বেশ কিছু অভিযোগে ব্যাংকটি তদন্তে নেমেছে বলে জানা গেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজশাহী কর্পোরেট-১ শাখার ব্যবস্থাপক ডিজিএম পদমর্যাদার হলেও দলীয় প্রভাব খাটিয়ে অনেক জ্যেষ্ঠ এজিএমকে ডিঙ্গিয়ে কনিষ্ঠ এজিএম হয়েও শাখার প্রধান হন বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি সোয়াইবুর রহমান খান। অথচ আগের কর্মস্থল রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট) শাখায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন স্থায়ী আমানতের সুদ না দিয়ে প্রায় ১০ কোটি টাকা অতিরিক্ত মুনাফা দেখান তিনি। ২০১৭ সাল হতে চলমান এ অনিয়ম বিভাগীয় কার্যালয়ের নিরীক্ষায় ধরা পড়লে ২০২৩ সালের বকেয়া সুদগুলো পরিশোধ করা হয়। কিন্তু ব্যাংকের লাভের বিপরীতে যে আয়কর দিতে হয় তা ইতোমধ্যে পরিশোধিত হয়ে যায়, যা ব্যাংকের জন্য একটি অতিরিক্ত আর্থিক ক্ষতি। শুধু তাই নয়, বগুড়া কর্পোরেট শাখায় দায়িত্ব পালনকালে মেসার্স রাজ্জাক ট্রেডার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে ১ কোটি টাকার লোন নবায়ন করেন তিনি। অথচ পরবর্তীতে ওই প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসা ও অস্তিত্ববিহীন বলে জানা যায়। এছাড়া, বগুড়া কর্পোরেট শাখায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম লঙ্ঘন করে পুনঃতফসিলকৃত ঋণের বিপরীতে রাখা সুদ হিসাব বহির্ভূতভাবে আয় হিসেবে নিয়ে শাখাকে লাভজনক দেখান তিনি, যা বড় ধরনের অনিয়ম বলেও জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, শুধু সোয়াইবুর রহমান খানই নন, রাজশাহী নগরীর সকল শাখা, জোনাল অফিস, বিভাগীয় অফিসে কর্মরত অধিকাংশ কর্মকর্তাই বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতা ও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত। ফলে রাজশাহীতে এই সিন্ডিকেটের হাতে গত ১৫ বছর ধরে জিম্মি রয়েছে রূপালী ব্যাংক।
সোয়াইবুর রহমান খান ছাড়াও এই সিন্ডিকেটের অন্য সদস্যরা হলেন- পাবনা জোনের ডিজিএম ও জোনাল ম্যানেজার উৎপল কবিরাজ, যশোর জোনের ডিজিএম ও জোনাল ম্যানেজার প্র্রকাশ কুমার সাহা (বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাবেক সভাপতি) এবং নওগাঁ জোনের ডিজিএম ও জোনাল ম্যানেজার মো. গোলাম নবী। এই কর্মকর্তারা প্রতি মাসে ৭ থেকে ১০ দিন রাজশাহী কর্পোরেট শাখা প্রধান সোয়াইবুর রহমান খানের কার্যালয়ে বসে স্বীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত কার্যালয়ের দায়িত্ব পরিচালনা করেন বলে অভিযোগ আছে।
এদিকে, সোয়াইবুর রহমান খানের বড় ভাই রুয়েট কর্পোরেট-২ শাখার ব্যবস্থাপক সেতাউর রহমান বঙ্গবন্ধু পরিষদের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক। তিনি দলীয় প্রভাব খাটিয়ে ও সিন্ডিকেটের সদস্য হওয়ায় সিনিয়র এসপিওদের ডিঙ্গিয়ে কনিষ্ঠ হয়েও এজিএম পদমর্যাদার ব্যবস্থাপকের পদ বাগিয়ে নেন।
তানোর, লক্ষীপুর ও রুয়েট শাখায় কর্মরত থাকাবস্থায় পর্যাপ্ত নথিপত্র ছাড়াই অনৈতিক সুবিধা নিয়ে অসংখ্য ঋণ দেওয়ার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। যে ঋণগুলোর বেশির ভাগই শ্রেণিকৃত হয়ে যাওয়ায় অন্য শাখা ব্যবস্থাপকরা পুনঃতফসিল করে তা নবায়ন করেন। আবার, বঙ্গবন্ধু পরিষদের আশীর্বাদ পুষ্ট মাইদুল হককে (এসপিও) কাকনহাট শাখায় ব্যবস্থাপক হিসেবে পদায়ন করা হলে তিনি ব্যাংকের বাইরের দুইজন জমির দালালের সঙ্গে যোগসাজশে নামে-বেনামে কয়েক কোটি টাকা ঋণ দেন। সেক্ষেত্রে অনৈতিকভাবে বিপুল অর্থের মালিক হয়ে কাকনহাট পৌরসভা এলাকায় ১২০ বিঘা জমি ক্রয় করেন বলে অভিযোগ আছে।
পরে বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে আসলে তার বিরুদ্ধে তদন্তের মাধ্যমে শাস্তি দেওয়ার বদলে রাজশাহী ক্যান্টনমেন্ট শাখায় পদায়ন করে পুরস্কৃত করা হয়। এই শাখাতেও একই অভিযোগ উঠলে কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করলেও বঙ্গবন্ধু পরিষদের মধ্যস্থতায় তাকে আবারও শাস্তির বদলে জোনাল অফিসে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে পদায়ন করে পুরস্কৃত করা হয়। এ কার্যালয়ে যোগদানের পর কেনাকাটা ও প্রকিউরমেন্ট সংশ্লিষ্ট বিষয়েও তিনি নানা অনিয়মে জড়িয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। অন্যদিকে, কে.এন.আই রোড শাখার ব্যবস্থাপক আবু রাইহান বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক, রাজশাহী ক্যান্টনমেন্ট শাখার ব্যবস্থাপক মো. জালাল উদ্দিন বঙ্গবন্ধু পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।
এছাড়া, লক্ষীপুর শাখা ব্যবস্থাপক তাদের সাথে সুর মিলিয়ে টিকে আছেন শুধু শহরের শাখায় ব্যবস্থাপক হিসেবে থাকার জন্য। তারাও দলীয় প্রভাব খাটিয়ে গত ১৫ বছর নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ব্যাংকের সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অভিযোগ করে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও বহাল তবিয়তে আছেন সোয়াইবুর রহমান খান গং, এখনও দেখিয়ে যাচ্ছেন দাপট। ফলে তাদের কর্মকান্ডে অতিষ্ঠ হয়ে বৈষম্যের শিকার সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রূপালী ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান বরাবর অভিযোগ দেন। ওই অভিযোগে বলা হয়, রাজশাহী বিভাগের অধীন কোন শাখায় কে ব্যবস্থাপক হবেন ও কোন শাখায় কোন কর্মকর্তাকে পদায়ন করতে হবে তা ঠিক করেন সোয়াইবুর রহমান খান গং। এই সিন্ডিকেটভুক্ত কর্মকর্তাদের নগরের আধুনিক সুবিধা সম্পন্ন শাখায় বছরের পর বছর রেখে দেওয়া হয়। এসব অনিয়মের ক্ষেত্রে সোয়াইবুর রহমান খানের প্রধান সহযোগী হিসেবে কাজ করেন রূপালী ব্যাংকের রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধু পরিষদের সহ-সভাপতি মো. রাকিব হাসান। তার স্ত্রী রাজশাহী মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শামিমা নাসরিন। ফলে স্ত্রীর প্রভাব খাটিয়ে মো. রাকিব হাসান নিজেও টানা ছয় বছর ধরে একই দায়িত্বে রয়েছেন।
অথচ, একই দায়িত্বে তিন বছরের বেশি থাকার নিয়ম নেই। এছাড়া, কোন শাখায় কোন গ্রাহককে কত টাকা ঋণ দেয়া হবে- তাও ওই সিন্ডিকেটই নির্ধারণ করে। বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তারা অভিযোগ করে বলেন, রূপালী ব্যাংকে ৮-১০ বছর ধরে কর্মরত অনেক কর্মকর্তা জ্যেষ্ঠতা, যোগ্যতা ও দক্ষতায় এগিয়ে থাকলেও শুধুমাত্র সোয়াইবুর রহমান খান গংয়ের সুনজরে না থাকার কারণে নগরীর শাখাগুলোতে পদায়ন পান না। এমনকি নগরীর বাইরের শাখাগুলোতেও প্রতিনিয়ত তাদের বদলি করে হয়রানি করা হয়।
ভুক্তোভোগীরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে অভিযোগ করে বলেন, এই বৈষম্য দূর করে জ্যেষ্ঠতা, যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে দায়িত্ব সমন্বয় করতে সম্প্রতি রাজশাহীর জোনাল ম্যানেজার ও বিভাগীয় প্রধান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) তানভীর হাসনাইন মইনের কাছে দাবি জানান ব্যাংকটির বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তারা।
কিন্তু তিনি দাবি নাকচ করে বলেন, দীর্ঘদিনের সাজানো এ বাগান নষ্ট করা যাবে না। তাছাড়া শাখা ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করার জন্য বর্তমানে দায়িত্বপ্রাপ্তদের চেয়ে রাজশাহী অঞ্চলে যোগ্য কোনো কর্মকর্তা নেই। তাই সকল কর্মকর্তাকে তাদের সাথে সমঝোতা করে চলতে হবে। সোয়াইবুর রহমান খানের বিরুদ্ধে তদন্তের বিষয়ে জানতে রূপালী ব্যাংকের রাজশাহী বিভাগীয় প্রধান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) তানভীর হাসনাইন মইন সরকারি চাকরির দোহাই দিয়ে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজী হননি। তিনি বলেন, ’আমার নেতৃত্বে ব্যাংকের ৫টা তদন্তের কাজ চলছে। তবে অফিসিয়াল সিক্রিট অ্যাক্ট অনুযায়ী কোর্টের অর্ডার ছাড়া কোনো বিষয় জানানোর সুযোগ নাই।
সার্বিক বিষয়ে জানতে সোয়াইবুর রহমান খানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে উঠা বদলি বাণিজ্য, পদন্নতি বাণিজ্য, সিন্ডিকেট গড়ে প্রভাব বিস্তার, অনৈতিক সুবিধা নেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগে তদন্ত চলছে বলে জানতে পেরেছি। তবে এ বিষয়ে আমার সাথে এখনও কেউ কোনো কথা বলেননি।
তাছাড়া, যেসব অভিযোগে তদন্ত চলছে সেগুলো করার সুযোগ আমার নেই। কারণ এগুলোর ক্ষমতা হেড অফিসের আছে, আমি তো শাখা অফিসে দায়িত্ব পালন করছি। রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি তা অস্বীকার করেন।
তবে কমিটির তালিকায় নাম থাকার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমি কখনও কোনো পদে ছিলাম না। সমস্ত অভিযোগই মিথ্যা। আমার পারফরমেন্সে ঈর্শান্তিত হয়ে একটা গ্রুপ এগুলো করছে।