স্বীকৃতি বিশ্বাস, যশোরঃ
“ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা,
যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা।
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা,
আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা॥
যমুনার হাতে ফোঁটা খেয়ে যম হল অমর।
আমার হাতে ফোঁটা খেয়ে আমার ভাই হোক অমর॥”
কালীপূজোর আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়ার ২দিন পর উত্তেজনায় ভরে ওঠে আর বলে ওঠে, এবার ভাইফোঁটা। কিছু দেওয়া নয়, পাওয়াও নয়, তবে ফোঁটা দিয়ে শুভ কামনা করা।
পৌরানিক দৃষ্টিতে কার্তিক মাসের শুক্লাদ্বিতীয়া তিথিতে এই উৎসব পালিত হয়। পঞ্জিকা মতে শুক্লাপক্ষের প্রথম তিথিতে এই উৎসব পালিত হয়। কথিত আছে যে, মৃত্যুর দেবতা যমরাজ নাকি তাঁর বোন যমুনার হাতে ফোঁটা নেন। তাই একে যমদ্বিতীয়াও বলা হয়।আবার কৃষ্ণ নরকাসুরকে বধ ফিরে আসতেই তাঁর বোন সুভদ্রা তাঁকে ফোঁটা দিয়ে মিষ্টি খাওয়ান। উত্তর ভারতে এই উৎসব “ভাইদুজ “ নামে পরিচিত। একটি প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, সূর্য ও সংজ্ঞার সন্তান যম ও যমী বা যমুনা। যমুনা নিজের ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দিয়েছিলেন, তার পর থেকে এই উৎসব পালিত হতে শুরু করে।
কথিত আছে, যমুনা নিজের ভাই যমকে একাধিক বার নিজের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে ধর্মরাজ যম নিজের বোনের আমন্ত্রণ রক্ষার্থে যেতে পারতেন না। কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে বাড়ির দ্বারে নিজের ভাই যমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, খুশিতে আত্মহারা হয়ে যান যমী। প্রসন্নতা ও স্নেহের সঙ্গে সেই তিথিতে নিজের ভাইকে ফোঁটা দেন ও ভোজন করান যমুনা। এর পর যম, যমীকে বর চাইতে বলেন। তখন, যমী ভাইয়ের কাছ থেকে প্রতিজ্ঞা নেন যে, প্রতি বছর তিনি কার্তিক শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়ায় যমীর বাড়িতে ভোজন গ্রহণ করতে আসবেন। পাশাপাশি এই বর চান যে, এই তিথিতে যে বোন নিজের ভাইকে ফোঁটা দিয়ে ভোজন করাবে, তাঁর কখনও যমের ভয় থাকবে না। তার পর থেকেই ভাই ফোঁটার রীতি পালিত হয়ে আসছে।
আবার যমুনার জলে স্নান করলে নরক যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় বলেও, মত প্রচলিত আছে। এমনও বর চেয়েছিলেন যমুনা। যম বোনের এই ইচ্ছাও পুরো করেন। কিন্তু পাশাপাশি সতর্ক করেন, যে ভাই নিজের বোনের তিরস্কার করবে ও অপমানিত করবে, তাঁকে যমপাশে বেঁধে যমপুরী নিয়ে যাবেন । তা সত্ত্বেও, ভাই যদি যমুনার জলে স্নান করে সূর্যকে অর্ঘ্য দেন, তা হলে স্বর্গলোকে তাঁর স্থান সুনিশ্চিত হবে। এদিন ভাই-বোনের যমুনায় স্নান করা শুভ মনে করা হয়।
মৎস্য পুরাণ অনুযায়ী, মৃত্যুর দেবতা যমকে সন্তুষ্ট করার জন্য ভাতৃদ্বিতীয়ার দিনে ষোড়শোপচার বিধিতে পুজো করা উচিত।
আবার অন্য এক প্রচলিত পৌরাণিক ব্যাখ্যা অনুযায়ী, নরকাসুর দৈত্য বধের পর কৃষ্ণ গৃহে ফিরলে, বোন সুভদ্রা প্রদীপ জ্বেলে, ফুল, ফল, মিষ্টি দিয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। এর পর কৃষ্ণের কপালে ফোঁটা দিয়ে তাঁকে মিষ্টি খেতে দেন সুভদ্রা। পাশাপাশি কৃষ্ণের আরও সহস্র বছর বেঁচে থাকার কামনা করেন। মনে করা হয়, তখন থেকেই ভাই ফোঁটার সূচনা।
নকশিকাঁথার কাজ করা সূতির আসনে ভাইকে বসিয়ে শুরু হয় ফোঁটা দেওযার অনুষ্ঠান। কাঁসা বা পিতলের থালায় ধান-দূর্বা, ঘরে আমপাতায় পারা কাজল, চন্দন সাজিয়ে রাখা হয় ভাইয়ের সামনে। সঙ্গে থাকে ঘিয়ের প্রদীপ ও শঙ্খ। আর মুখ মিষ্টি করানোর জন্য থাকে ভাইয়ের পছন্দের সমস্ত মিষ্টিও। এর পর বোনেরা বাঁ হাতের কড়ে আঙুলে কাজল নিয়ে এঁকে দেয় ভাইয়ের ভ্রু-যুগল। এর পর ভাইয়ের কপালে চন্দনের ফোঁটা দেওয়ার সময় ছড়া কাটে বোনেরা—
‘ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা,
যম দুয়ারে পড়ল কাঁটা।
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা,
আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা।’
চন্দনের ফোঁটা দেওয়ার পর শঙ্খ ধ্বনির মাঝে ধান-দূর্বা দিয়ে ভাইকে আশীর্বাদ করে বোন। তার পর মিষ্টিমুখ করার পালা। এ ভাবেই বাংলার ঘরে ঘরে পালিত হয়ে আসছে ভাই-বোনের অটুট বন্ধনের উৎসব ভাই ফোঁটা। পূর্ব বঙ্গীয় কিছু বাঙালিদের মধ্যে প্রতিপদের দিন ভাইফোঁটা দেওয়ার নিয়মও প্রচলিত।এছাড়া মহারাষ্ট্র, গোয়া ও কর্ণাটকে ভাইফোঁটা “ভাইবিজ” বলে। এতো গেল সমতলে ভাইফোঁটার বিভিন্ন নামকরণ। নেপাল ও পার্বত্য অঞ্চলে এই উৎসবকে “ভাইটিকা “ বলা হয়।
ভাইফোঁটা দিতে দই, চন্দন, ধান, দুর্বা, শঙ্খ, প্রদীপ ইত্যাদি উপকরণ লাগে। দই দিয়ে চন্দন নিয়ে, কনিষ্ঠা আঙ্গুল দিয়ে দিদি ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দেবে। আর সেটা তিনবার দিবে। ফোঁটা দেওয়া শেষ হলে ভাইয়ের মাথায় দুর্বা, ধান দিয়ে আশীর্বাদ করবে। ভাই যখন বড়ো, তখন বোন দাদাকে প্রণাম করবে আর দাদা তার মাথায় ধান ও দুর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করবে। একটা কথা বলে রাখি উলুধ্বনি আর শঙ্খ বাজাতে কেউ ভুলবেন না। আর একটা কথা বলি, উপোস করে ফোঁটা দিচ্ছি তাই উপহার নিতে ভুলবেন না কেউ। আরে এটাই তো মজা – উপহার যত ছোট্ট হোক সেটা উপহার তো, তাতেই হবে। আর দিদিরা উপহার দিলে ভাইরা নিতে ভুলবেন না। আর এভাবে আনন্দ, উল্লাসের মধ্য দিয়ে শুভ ভ্রাতৃদ্বিতীয়া পালন করা হয়।