তাল পিঠা গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য। সেই সংস্কৃতি তুলে ধরে টানা তৃতীয়বারের মতো এবারও নওগাঁর নিয়ামতপুরের ঘুঘুডাঙ্গা তাল সড়কে বসেছে তাল পিঠা মেলা। নওগাঁর ঐতিহ্যবাহী পিঠা মেলায় স্বাদ নিতে রসনা বিলাসীদের ভীড়ে জমে উঠেছে তাল পিঠা মেলা। বরেন্দ্র অঞ্চলের ঐতিহ্য তুলে ধরতে তৃতীয় বারের মতো পিঠা মেলার আয়োজন করছে স্থানীয় প্রশাসন। আর এই তাল সড়ক ও তাল পিঠা মেলার স্রষ্টা স্থানীয় সংসদ সদস্য ও খাদ্যমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা সাধন চন্দ্র মজুমদার।
প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক চিরন্তর, কারণ প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের অস্তিত্ব এক সুতায় বাঁধা। তৃণমূল পর্যায়ে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি। টেকসই উন্নয়ন ও আর্থিক সমৃদ্ধির প্রায় সকল ক্ষেত্রেই প্রকৃতির যেমন রয়েছে নিবিড় যোগাযোগ তেমনই ভ্রমণপিপাসু মানুষের জন্য প্রকৃতি এক নির্মল বিনোদনের আধার। প্রকৃতি প্রেমিক মানুষের জন্যই এমন এক স্থান ঘুঘুডাঙ্গা তালসড়ক। প্রায় দুই কিলোমিটার জুড়ে রাস্তার উভয় পাশে সারি সারি তাল গাছের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য শুধু চোখ জুড়ায় না মনকেও করে প্রকৃতির মতই সবুজ-কোমল। প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্য উপভোগ করতে সাধারণ মানুষ প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসে সবুজ গ্রাম ঘুঘুডাঙ্গায়।
তাল সড়ক সৃষ্টির ইতিহাস:
নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলার হাজিনগর ইউনিয়নের ছোট্ট গ্রাম ঘুঘুডাঙ্গা। হাজিনগর গ্রামের মজুমদার মোড় থেকে ঘুঘুডাঙ্গা প্রায় দুই কিলোমিটার জুড়ে রাস্তার উভয় পাশে শতশত তাল গাছের সারির কারনে স্থানটি পরিচিতি পেয়েছে ঘুঘুডাঙ্গা তাল সড়ক নামে। তবে এই তাল সড়কে রয়েছে গর্বের ইতিহাস। যে ইতিহাস আমাদের নিয়ে যাবে ১৯৮৬ সালে। নওগাঁ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, নওগাঁ-১ আসনের সংসদ সদস্য ও খাদ্যমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা সাধন চন্দ্র মজুমদার ১৯৮৬ সালে হাজিনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান থাকাকালে নিজ হাতে রোপণ করেছিলেন এই সব তাল গাছের চারা। তৎকালীন সময়ে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ছিলেন সাবেক ১ নং ওয়ার্ড সদস্য মৃত হোসেন আলী, মৃত মোহাম্মদ আলী, মৃত সাধু চরণ পাহান, ২নং ওয়ার্ডের সদস্য নরেশ চন্দ্র মজুমদার, সুরেশ চন্দ্র বর্মন, হাবিবুর রহমানসহ আরো ৫ জন সদস্য। সেই সময়ের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও বর্তমান খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার মনে প্রাণে বিশ্বাস করেছিলেন গ্রামীণ জীবনে পিঠাপুলি আর জীবিকার সঙ্গে জড়িয়ে আছে তালগাছ।
এর পাশাপাশি কৃষকদের জন্য ছায়াদায়ী ও বজ্রপাতরোধী বৃক্ষ হিসেবেও তালগাছ সুপরিচিত।রোদ ও বজ্রপাত থেকে কৃষকদের রক্ষা করতে তিনি তালগাছ রোপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কালের বিবর্তনে সেই গাছগুলোই ৫০-৬০ ফুট লম্বা হয়ে রাস্তার দুই ধারে শোভা বর্ধন করে আসছে। প্রায় ৩৬ বছর কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাছগুলো। তাঁরই পরিকল্পনা ও দিকনির্দেশনা মোতাবেক ২০২০ সালে উপজেলা পরিষদের অর্থায়নে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর হতে প্রাপ্ত নির্বাচনী এলাকা ভিত্তিক টি,আর/কাবিখা/কাবিটা প্রকল্প ও স্থানীয় সরকার বিভাগের মাধ্যমে তাল সড়কে আগত দর্শনার্থীদের জন্য সড়কের উভয় পাশে নান্দনিক পরিবেশে বসার সুব্যবস্থা করেছে উপজেলা প্রশাসন। গাছের ডালে বাবুই পাখির দৃষ্টিনন্দন বাসা পাখ-পাখালির কলকাকলি আকর্ষণ করে পর্যটকদের। এই তালগাছ গুলো রোপন করার জন্য চারা সংগ্রহে তৎকালীন হাজিনগর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে কোন প্রকার আর্থিক সাহায্য নেওয়া হয় নি। তৎকালীন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং বর্তমান খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের ব্যক্তিগত উদ্যোগে এইসব তালগাছ রোপন করা হয়েছিল।
তাল সড়কে তাল পিটা উৎসবের সৃষ্টির ইতিহাস :
তাল পিঠা বরেন্দ্র অঞ্চলের ঐতিহ্য। ভাদ্র-আশ্বিন মাসে আউশের নতুন চালের সাথে পাকা তালের মিষ্টি রস মিশিয়ে হরেক রকম পিঠা তৈরি করা হয়। এ অঞ্চলের তাল পিঠা ও তাল রুটির আয়োজনে মেয়ে-জামাইকে আপ্যায়ন করার ঐতিহ্য শত বছরের। তাই তাল গাছ শুধু গাছ নয়, বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ। চিরায়ত বাংলা ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে ২০২১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার এঁর অনুপ্রেরণায় ঘুঘুডাঙ্গা তাল সড়কে প্রথম বারের মতো আয়োজন করা হয় তাল পিঠা উৎসব। সেই সময় উৎসবটির আয়োজন করেন হাজিনগর ইউনিয়ন পরিষদ। এরপর থেকে প্রতি বছর ২৪ সেপ্টেম্বর তাল পিঠা উৎসব আয়োজন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
তাল পিঠা উৎসবে তাল সড়কের চিত্র:
২৪ সেপ্টেম্বর উৎসবটি শুরু হওয়ার কথা থাকলেও পরবর্তী বছর গুলোতে ২২ তারিখ থেকে শুরু হয়ে যায় উৎসবের মূল আমেজ, যার সমাপ্তি দিন হচ্ছে ২৪ তারিখে। উৎসবের দিনে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণী পেশার হাজার হাজার মানুষের অংশগ্রহণে তাল সড়ক পরিণত হয় মিলন মেলায়। তাল সড়কের পাশেই নির্মাণ করা হয়েছে একটি দীঘি। গাছের ফাঁকে ও দীঘিটির চতুর্পাশে বসে হরেক রকম পিঠার স্টল। স্টলগুলোতে থরে থরে সাজানো থাকে কানমুচড়ি, ফুলঝুরি, মুইঠা, পুলি, পাতা নকশিসহ হরেক রকম পিঠা। সড়কের পাশে উন্মুক্ত স্থানে লোকগান আর নৃত্যের ঝংকারে উৎসরিত গ্রাম বাংলার প্রাণের সুর। উৎসবের দিনগুলোতে পুরো দুই কিলোমিটার তাল সড়কটি দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখরিত থাকে। উৎসবের দিনগুলোতে শুধু ঘুঘুডাঙ্গা গ্রামেই না আশপাশের গ্রামগুলোতেও মেয়ে-জামাই, আত্মীয়-স্বজনের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। পাশাপাশি প্রায় সব বাড়িতেই চলে তাল পিঠা তৈরীর পসরা।
২০২৩ সালের তাল পিঠা উৎসবের বিবরণ:
উপজেলার হাজিনগর ইউনিয়নের ঘুঘুডাঙ্গা তাল সড়কে তৃতীয় বারের মতো আয়োজন করা হচ্ছে এই তাল পিঠার মেলা। গত শুক্রবার বিকেলে প্রধান অতিথি থেকে মেলার উদ্বোধন করেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন জেলা প্রশাসক (ডিসি) গোলাম মাওলা ও জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) রাশিদুল হক।
দূর দূরান্ত থেকে এই তাল সড়কে তার পিঠা উৎসবে উপস্থিত হচ্ছে ভ্রমণ পিপাসু মানুষেরা। এই বছরেও মেলাতে থাকছে দেশের বিভিন্ন নামিদামি মানুষেরা। গত বছর এই তালপিটা মেলাতেই উপস্থিত হয়েছিলেন চ্যানেল আই এর জনপ্রিয় অনুষ্ঠান হৃদয় মাটি ও মানুষের সঞ্চালক শাইখ সিরাজ। এই বছরে উপস্থিত ছিলেন চলচ্চিত্র অঙ্গনের চেনা মুখ চিত্রনায়ক ফেরদৌস সহ বহু খ্যাতিমান মানুষ।
আয়োজক কমিটি জানিয়েছে, বিভিন্ন এলাকা থেকে অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠান পিঠা মেলায় অংশ নিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান বৈচিত্র্যময় সব পিঠার সম্ভার নিয়ে হাজির হয় মেলায়। বানানো পিঠার মধ্যে রয়েছে জামাই পিঠা, তাল বড়া, হৃদয়হরণ, ঝিনুক পিঠা, তালক্ষীর, কানমুচড়ি, পাকান, পুলি ইত্যাদি।
নিয়ামতপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইমতিয়াজ মোরশেদ বলেন, তাল সড়কের তাল পিঠা উৎসব অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে যেভাবে বিকশিত করে সেভাবেই এই সব গ্রামীণ মানুষদের বিনোদনের যে অভাব আছে সেই বিনোদনের অভাবটা পূরণ করে।
এ বিষয়ে দর্শনার্থীরা বলেন, ঘুঘুডাঙ্গা তাল সড়কের তাল উৎসবে যদি বাঙালিরা আসে তাহলে বাঙালিয়ান যে ভাবটি রয়েছে সে ভাবটি ফিরে পাবে। বর্তমান প্রজন্ম হয়তো বা তালের রস দিয়ে যে কত প্রকার পিঠা তৈরি করা হয় এবং সেইগুলো পিঠার স্বাদ কেমন হয় তা জানে না, বাঙালির যে শত বছরের ঐতিহ্য এবং সেই সব পিঠার যে স্বাদ এটা উপভোগ করতে হলে ঘুঘুডাঙ্গা পিঠা উৎসবে আসতে হবে।
দোকানিরা বলছেন, গত বছরগুলো থেকে এই বছর বেড়েছে পিঠার চাহিদা। নতুন স্বাদ নিয়ে এসেছে তালের মিষ্টি, রোল সহ বেশ কয়েক রকম পিঠা।
চিত্রনায়ক ফেরদৌস বলেন:
আমার কাছে মেলা উৎসব এইগুলো শুনলেই ভালো লাগে, এগুলো মেলা আমার প্রাণের সংস্কৃতির একটি ব্যাপার। ঘুঘুডাঙ্গার এই তাল সড়কের মেলা যে এত বড় এবং এত সুন্দর পরিসরে করা হয় তা এখানে না আসলে বুঝতাম না।
এ বিষয়ে তাল সাম্রাজ্যের স্রষ্টা খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজমুদার বলেন, হাজিনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান থাকাকালীন ১৯৮৬ সালে ঘুঘুডাঙ্গার এ রাস্তায় প্রায় ৩ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে তালবীজ রোপণ করেছিলাম। সেই গাছগুলো এখন বড় হয়ে তাল দিচ্ছে। এক সময় প্রতিটি পুকুরের ধারে তালগাছ ছিল। ধুপধাপ করে পাকা তাল পড়তো। তাল কুড়ানো একটা উৎসব ছিল। মাটির বাড়ি তৈরি হওয়ায় সেসব গাছ কাটা পড়েছে। ভবিষ্যত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, তাল গাছের ঐতিহ্য ধরে রাখতে এবং বজ্রপাত নিরোধক হিসেবে রোপণ করা হয়েছিল।
সে সময় ২৫ পয়সা দাম দিয়ে তালবীজ কিনে এ রাস্তার পাশে রোপণ করা হয়েছিল। যারা তালবীজ লাগায় তাদের কপালে তাল জোটে না। কিন্তু আমি তালবীজ লাগিয়ে তা থেকে তাল খাচ্ছি। এমনকি আমার সন্তান ও নাতি-নাতনিরাও খাচ্ছে।এরই মধ্যে পর্যটকদের কাছে তালতলি পরিচিত পেয়েছে পর্যটন এলাকা হিসেবে। বর্তমান ঘুঘুডাঙ্গার আশপাশের গ্রামগুলোতেও লোকজ আমেজের সৃষ্টি হয়েছে।
এই উৎসব গতকাল ২২ তারিখ থেকে শুরু হয়ে চলবে আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর পযন্ত। এই মেলায় ফুটে উঠেছে তাল পিটার ঐতিহ্য লোকসংস্কৃতি ও গ্রামীণ জনজীবনের বৈচিত্র। ফলে নির্মল বিনোদন পাশাপাশি গ্রাম বাংলার হারিয়ে যেতে বসা অনেক ধরনের পিঠাপুলির সাথেও পরিচিত হচ্ছে বর্তমান প্রজন্ম। এভাবেই তাল পিঠা উৎসব হয়ে উঠেছে প্রাণের উৎসব, সম্প্রীতির উৎসব। আর সাধন চন্দ্র মজুমদার এঁর এক সাধারণ উদ্যোগ হয়ে উঠেছে অনন্য, অসাধারণ। আরো বেশি তাল গাছ লাগানোর স্বপ্ন দেখেন খাদ্যমন্ত্রী। তার দেখানো পথে এখন অনেকেই তালগাছ রোপন করছেন। তালের রস ও গুড় বিক্রি করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন এ অঞ্চলের মানুষ। বৃহৎ পরিসরে তাল শিল্পের উন্নয়ন হলে তাল মিছরি উৎপাদন বাড়বে। মন্ত্রী মনে করেন তালগাছকে কেন্দ্র করে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান গড়ে তোলা সম্ভব।