বাংলাদেশ ০৭:২৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
নোটিশ :

সাংবাদিক নিয়োগ চলছে,, সাংবাদিক নিয়োগ চলছে,,০১৯৯৯-৯৫৩৯৭০, ০১৭১২-৪৪৬৩০৬,০১৭১১-০০৬২১৪ সম্পাদক

     
ব্রেকিং নিউজ ::
প্রেমিকার বাড়ির সামনে বিষপাণে প্রেমিকের মৃত্যু; বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য সড়কের ধুলাবালির দূষণে অতিষ্ঠ জনজীবন,চরম হুমকিতে জনস্বাস্থ্য নরসিংদীতে মরা নদীর তীরে অষ্টমী স্নানে ভক্ত পূণ্যার্থীদের ঢল কলাপাড়ায় মহাসড়কে মোটরসাইকেল সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত-১ ভালুকায় ফিসারির পাড় মেরামত করা নিয়ে প্রতিপক্ষের হামলায় আহত- ১ খানসামায় জুয়া খেলার অপরাধে ৬ জনের কারাদণ্ড বিদ্যুৎ বিল বিতরনের অনিয়ম ফুলবাড়ীতে এক বাড়ীর বিদ্যুৎ বিল আর এক বাড়ীতে হোসেনপুরে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম অষ্টমী স্নানোৎসব অনুষ্ঠিত।  মণিরামপুরে চার মাসের শিশু ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত, বিত্তবানদের সহযোগিতা কামনা  কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অমান্য, তফসিল ঘোষণার পরেও এমপি কালামের চেয়ারম্যান প্রার্থী চূড়ান্ত পঞ্চগড়ে পরিবেশ বান্ধব বনায়ন ও ট্যুরিজম বিষয়ক কর্মশালা অনুষ্ঠিত টাকা দিয়ে সেচ পাম্পের পানি পাচ্ছে না হরিপুরের কৃষকরা মহাতীর্থ লাঙ্গলবন্দের অষ্টমী স্নান হিজলায় ইট ভাটার পুরাতন ডিম্বা (চুলা) ভেঙ্গে ২ জন শ্রমিক আহত  পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে সদর হাসপাতালে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন 

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ত্রাস ছিলেন ভান্ডারিয়ার কৃষকনেতা গগন মোহন: বিস্মৃত দুই বীর আজো রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পাইনি

  • নিজস্ব সংবাদ :
  • আপডেট সময় ০৯:৩৪:৪৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১ মার্চ ২০২২
  • ১৭২৪ বার পড়া হয়েছে

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ত্রাস ছিলেন ভান্ডারিয়ার কৃষকনেতা গগন মোহন: বিস্মৃত দুই বীর আজো রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পাইনি

 

 

 

 

মামুন হোসেন নিজস্ব প্রতিবেদক :

 

 

ব্রিটিশ আমলে ইংরেজ শাসনের শোষন ও নির্যাতন প্রতিবাদে ১৮৫৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলার সিংহখালী গ্রামের গগন ও মোহন নামে দুইভাই নেতৃত্ব দিয়ে ইংরেজ শক্তির সম্মুখে ত্রাস রুপে আবির্ভূত হয়েছিলো। শুধু তাই নয় ইংরেজ তালুকদের খাজনা দেয়া বন্ধের নির্দেশ দেয় কৃষকদের। সিংহখালী ওই বিদ্রোহে ঘটনাস্থলে ১৭ জন বিদ্রোহী কৃষক নিহত হয়। গগন ও মোহন ছিলেন জমিদার শেখ দৌলত এর দুই ছেলে।

 

 

 

কিন্তু তাদের এ বীরত্বকে গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশ আজো কোন সম্মাননা উদ্যোগ নেয়নি। ফলে তাদের সংগ্রাম ও ত্যাগ ইতিহাসের পাতায় বন্ধি রয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার গগন ও মহনের বাড়ি পরিদর্শনে গেলে তার বংশধর ও একাধিক তথ্য সুত্র জানায়, পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতা হারানোর পরই এদেশে ইংরেজ শাসন প্রবর্তিত হয়। ব্রিটিশ সরকার ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা চালু করে এবং তালুকভিত্তিক জমিদার ও মিরাসদার শ্রেণী সৃষ্টি করে তাদের উপর এদেশের মানুষের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের ভার অর্পণ করে। জমিদার, মিরাসদাররা অবিবেচকের মতসাধারণ প্রজারকাছ থেকে খাজনা আদায় শুরু করে। এর ফলে ইংরেজ কর্তৃক এ দেশবাসীর ওপর নিমে আসে শোষন ও নির্যাতন।

 

 

তৎকালীন বাকেরগঞ্জ জেলার অন্তর্গত মঠবাড়িয়া ও ভান্ডারিয়া নিয়ে পরগণা সৈয়দপুর গঠিত ছিল। সৈয়দপুর পরগণার দশ আনার মালিক ছিল ঢাকার মিত্রজিত সিং এবং দু’আনার মালিক ছিল বিরজা রতন দাস। ফরিদপুর জোর গেরদা নিবাসী শেখ দৌলত মিত্রজিতদের অধীনে তালুক লাভ করে ভা-ারিয়ার সিংহখালী গ্রামে জঙ্গল আবাদ করে বসতি স্থাপন করে শেখ দৌলত এর দুই পুত্র শেখ গগন মিয়া ও মোহন মিয়া। ওই গ্রামের একটি খালের পশ্চিম পাড়ে গগন মিয়া ও পূর্ব পাড়ে মোহন মিয়া ১৭ হাত পরিখা খনন করে ৪০ একর ভূমির ওপর বসতবাড়ী নির্মাণ করেন। তৎকালীন তালুকের দখল নিয়ে মিত্রজিত ও বিরজা রতন দাসের পরিবারের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিবাদ ছিল। এ সময় গগন ও মোহন অনেক কৃষক পরিবারকে নিয়ে সুন্দরবন আবাদ করলেও মিত্রজিত গগন, মোহন ও কৃষকদের নামে ভূমি কবলিয়াত দিতে অস্বীকার করে, মিত্রজিত তালুক মদন ঘোষকে বন্দোবস্ত দেন। এতে গগন ও মোহনের নির্দেশে কৃষকরা মিত্রজিতদের খাজনা দেয়া বন্ধ করে দেয়।

 

 

এ ঘটনায় জেরে গগন ও মোহন মদন ঘোষের লম্বা টিকি কেটে দেয় এবং তাকে সিংহখালীতে নেয়া হয়। মদন ঘোষের টিকি কাটা হতে মঠবাড়িয়ার ঘোষের টিকিকাটা গ্রামের নামকরণ হয়ে যায়। এ দিকে মদন ঘোষকে টুকরা টুকরা করে কেটে হত্যা করা হয়। মদন ঘোষের খুন মামলায় গগন, মোহনের যাবজ্জীবন সাজা হয় এবং আন্দামানে দ্বীপান্তর হয়। সেখানে জেল সুপারের স্ত্রীকে সর্পাঘাতে মরণাপন্ন হয়। গগন তাকে ওঝালি করে ভাল করে তোলে এবং পুরস্কার স্বরূপ ৫ বছর পরে উভয় ভ্রাতা মুক্তি লাভ করে। বিরজা রতন দাসের অনুগ্রহ লাভ করে গগন, মোহন তাদের তালুক উদ্ধার করে। উপায়ান্ত না পেয়ে মিত্রজিত সিং ব্রিটিশ কোম্পানির সহযোগিতায় পুলিশ দিয়ে কয়েক বার গগন ও মোহনকে গ্রেফতার চেষ্টা করায়।

 

 

কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায় এবং গগন, মোহন মিত্রজিতদের সৈয়দপুর পরগণার দশ আনা দখল করে নেয়। তারা কৃষকদের নিকট হতে লুফা বা টর্চ সালামী আদায় করে একটি শক্তিশালী বাহিনী গঠন ও সুরক্ষিত দুর্গ নির্মাণ করেন। তৎকালীন জমিদার ইংরেজ সরকারের সৈন্য ও পুলিশ নিয়ে প্রজাদের ওপর নির্যাতন চালাত। ১৮৫৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন বাকেরগঞ্জের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ হ্যারিসন দেশীয় পুলিশ ও একদল ইংরেজ সৈন্য নিয়ে সিংহখালীতে আসেন এবং বর্তমান তেলিখালী ইউনিয়নে অবস্থান করে। সেখান থেকে ঘোড়ায় চড়ে ম্যাজিস্ট্রেট সিংহখালী আসার পথে গগন, মোহন জঙ্গল হতে গুলি করে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের মাথার টুপি উড়িয়ে দেন। এ সময় উভয়পক্ষের মধ্যে তীব্র লড়াই হয়। ফলে ওই সময় গগন, মোহন তাদের বাড়ি ছেড়ে জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। ওই সময় মিঃ হ্যারিসন গগন, মোহনের পরিত্যক্ত বাড়ি যান এবং তাদের বাড়ি যুদ্ধের জন্য সুরক্ষিত দেখে তিনি বিস্মিত হন। যা ১৮৫৪ সালে ২৮ ফেব্রুয়ারি লিখিত পত্রে হ্যারিসন সিংহখালী গমন ও সংঘর্ষের বিবরণ দিয়েছিলেন। হ্যারিসনের পর মিঃ আলেকজান্ডার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে আসেন এবং তিনি গগন ও মোহনকে গ্রেফতার করার জন্য তিন থানার পুলিশ ও শত শত চৌকিদার প্রেরণ করেন।

 

 

তারা পরাজিত হয়ে ফিরে আসে। এ সংবাদে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডার ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েন। তিনি নিজে অনেক পুলিশ ও ইংরেজ সৈন্য নিয়ে দু’মাইল হেঁটে খাল অতিক্রম করে সিংহখালী গমন করেন। তাকে সমর্থন করতে এগিয়ে আসেন মোরেলগঞ্জের মিঃ মোরেল ভ্রাতৃদ্বয় বাহিনী। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে হঠাৎ ঢাল, লেজা নিয়ে গগন, মোহন মিঃ আলেকজান্ডারকে আক্রমণ করে। আবারও উভয়পক্ষের মধ্যে চরম সংঘর্ষ শুরু হয়। এতে ঘটনাস্থলে ১৭ জন বিদ্রোহী কৃষক নিহত হয়। এ সময় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহনের বাড়ি দখল করার চেষ্টা করলে বিদ্রোহীরা ভিতর হতে গুলিবর্ষণ করে। তখন পুলিশ বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তাড়াতাড়ি মোহনের বাড়ি ত্যাগ করে পালিয়ে যান। পালিয়ে যাবার সময় তিনি পুলিশ বাহিনীকে মৃতদেহগুলো আনার নির্দেশ দেন। কিন্তু পুলিশ প্রাণভয়ে পলায়ন করে। গগন, মোহন ১৭ জন বিদ্রোহী কৃষকের মৃতদেহ উদ্ধার করে মোহনের বাড়ির দরজায় কবর দেয়। এখনো তাদের কবরগুলোর সংরক্ষিত রয়েছে।

 

 

ইংরেজ প্রশাসন জমিদারদের সাথে একত্র হয়ে কৃষকদের ওপর অমানুষিক অত্যাচার নির্যাতন করতে থাকলে শেষ পর্যন্ত গগন ও মোহন বৃটিশ সরকারের কোর্টে উপস্থিত হয়। সরকার তাদেরকে ৮টি মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত করে। তৎকালীন বাকেরগঞ্জের জেলার মিঃ স্টিয়ার ১৮৫৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর এবং ১৮৫৫ সালের ৫ জানুয়ারি গগন ও মোহনের বিরুদ্ধে আনীত মামলার রায় দেয় এবং উভয় ভ্রাতাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করে আদালত। উভয় ভ্রাতা ৬০ বছর বেঁচে ছিল এবং ৩০ বছরই কারাগারে ছিল। শেষ জীবনে মুক্তি পেয়ে সিংখালী ফিরে আসে। তাদের বংশধররা ভা-ারিয়া উপজেলার সিংহখালী গ্রামের মিয়াবাড়িতে বাস করছে। গগন ও মোহনের বংশধর জাকির হোসেন মিয়া বলেন, সিংহপুরুষ গগন ও মোহন মিয়া কৃষকদের অধিকার আদায়ে ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও সংগ্রাম করেছে। কিন্তু বিনিময়ে এই বীর যোদ্ধারা রাষ্টের পক্ষ থেকে সামান্য সম্মাননাও পাইনি। আমাদের বাড়ি বহুবার বিভিন্ন সময় সরকারের লোকজন সহ দেশ-বিদেশী সাংবাদিকরা খোঁজ খবর নিতে এসে লেখালেখি করে কিন্তু এ বিষয়টি নিয়ে সরকারের কোন মহত্ব বা সম্মাননার উদ্যোগ আজো দেখিনি।

 

 

 

তিনি আরো বলেন, এই গগন ও মোহন মিয়ার বংশে আল্লাহর ইচ্ছায় ২২ জন ওয়ারিশ এখনো বেঁেচ আছে। তারা বর্তমানে ৬০ বিঘা সম্পত্বির ওপর বসবাস করছেন। এই বংশধরের দাবি, সিংহপুরুষ গগন ও মোহনকে আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রীয় সম্মানা জানানো হউক এবং যোদ্ধার পরিবার হিসেবে তাদেরও মূল্যায়ন করার আহবান করেন। এ বিষয়ে ঐতিহ্যবাহী ভা-ারিয়া শাহাবুদ্দীন ফাজিল (ডিগ্রি) মাদরাসার ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক মো: বশির উদ্দিন জানান, বরিশালের বীর সন্তানরা ইংরেজ শাসন ও তাদের তাবেদার জমিদারদের শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছিলেন। তার মধ্যে সিংহখালী গ্রামের গগন ও মহন মিয়ার বীরত্ব অন্যতম। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ স্বাধীন দেশে সেই আত্মত্যাগী বীর পুরুষরা আমাদের মাঝ থেকে প্রায় বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাচ্ছেন। যোদ্ধা হিসেবে এ সকল সংগ্রামী বীরদের রাষ্ট্রের মূল্যয়ন করা উচিত ছিলো।

 

 

 

জনপ্রিয় সংবাদ

প্রেমিকার বাড়ির সামনে বিষপাণে প্রেমিকের মৃত্যু; বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ত্রাস ছিলেন ভান্ডারিয়ার কৃষকনেতা গগন মোহন: বিস্মৃত দুই বীর আজো রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পাইনি

আপডেট সময় ০৯:৩৪:৪৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১ মার্চ ২০২২

 

 

 

 

মামুন হোসেন নিজস্ব প্রতিবেদক :

 

 

ব্রিটিশ আমলে ইংরেজ শাসনের শোষন ও নির্যাতন প্রতিবাদে ১৮৫৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলার সিংহখালী গ্রামের গগন ও মোহন নামে দুইভাই নেতৃত্ব দিয়ে ইংরেজ শক্তির সম্মুখে ত্রাস রুপে আবির্ভূত হয়েছিলো। শুধু তাই নয় ইংরেজ তালুকদের খাজনা দেয়া বন্ধের নির্দেশ দেয় কৃষকদের। সিংহখালী ওই বিদ্রোহে ঘটনাস্থলে ১৭ জন বিদ্রোহী কৃষক নিহত হয়। গগন ও মোহন ছিলেন জমিদার শেখ দৌলত এর দুই ছেলে।

 

 

 

কিন্তু তাদের এ বীরত্বকে গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশ আজো কোন সম্মাননা উদ্যোগ নেয়নি। ফলে তাদের সংগ্রাম ও ত্যাগ ইতিহাসের পাতায় বন্ধি রয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার গগন ও মহনের বাড়ি পরিদর্শনে গেলে তার বংশধর ও একাধিক তথ্য সুত্র জানায়, পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতা হারানোর পরই এদেশে ইংরেজ শাসন প্রবর্তিত হয়। ব্রিটিশ সরকার ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা চালু করে এবং তালুকভিত্তিক জমিদার ও মিরাসদার শ্রেণী সৃষ্টি করে তাদের উপর এদেশের মানুষের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের ভার অর্পণ করে। জমিদার, মিরাসদাররা অবিবেচকের মতসাধারণ প্রজারকাছ থেকে খাজনা আদায় শুরু করে। এর ফলে ইংরেজ কর্তৃক এ দেশবাসীর ওপর নিমে আসে শোষন ও নির্যাতন।

 

 

তৎকালীন বাকেরগঞ্জ জেলার অন্তর্গত মঠবাড়িয়া ও ভান্ডারিয়া নিয়ে পরগণা সৈয়দপুর গঠিত ছিল। সৈয়দপুর পরগণার দশ আনার মালিক ছিল ঢাকার মিত্রজিত সিং এবং দু’আনার মালিক ছিল বিরজা রতন দাস। ফরিদপুর জোর গেরদা নিবাসী শেখ দৌলত মিত্রজিতদের অধীনে তালুক লাভ করে ভা-ারিয়ার সিংহখালী গ্রামে জঙ্গল আবাদ করে বসতি স্থাপন করে শেখ দৌলত এর দুই পুত্র শেখ গগন মিয়া ও মোহন মিয়া। ওই গ্রামের একটি খালের পশ্চিম পাড়ে গগন মিয়া ও পূর্ব পাড়ে মোহন মিয়া ১৭ হাত পরিখা খনন করে ৪০ একর ভূমির ওপর বসতবাড়ী নির্মাণ করেন। তৎকালীন তালুকের দখল নিয়ে মিত্রজিত ও বিরজা রতন দাসের পরিবারের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিবাদ ছিল। এ সময় গগন ও মোহন অনেক কৃষক পরিবারকে নিয়ে সুন্দরবন আবাদ করলেও মিত্রজিত গগন, মোহন ও কৃষকদের নামে ভূমি কবলিয়াত দিতে অস্বীকার করে, মিত্রজিত তালুক মদন ঘোষকে বন্দোবস্ত দেন। এতে গগন ও মোহনের নির্দেশে কৃষকরা মিত্রজিতদের খাজনা দেয়া বন্ধ করে দেয়।

 

 

এ ঘটনায় জেরে গগন ও মোহন মদন ঘোষের লম্বা টিকি কেটে দেয় এবং তাকে সিংহখালীতে নেয়া হয়। মদন ঘোষের টিকি কাটা হতে মঠবাড়িয়ার ঘোষের টিকিকাটা গ্রামের নামকরণ হয়ে যায়। এ দিকে মদন ঘোষকে টুকরা টুকরা করে কেটে হত্যা করা হয়। মদন ঘোষের খুন মামলায় গগন, মোহনের যাবজ্জীবন সাজা হয় এবং আন্দামানে দ্বীপান্তর হয়। সেখানে জেল সুপারের স্ত্রীকে সর্পাঘাতে মরণাপন্ন হয়। গগন তাকে ওঝালি করে ভাল করে তোলে এবং পুরস্কার স্বরূপ ৫ বছর পরে উভয় ভ্রাতা মুক্তি লাভ করে। বিরজা রতন দাসের অনুগ্রহ লাভ করে গগন, মোহন তাদের তালুক উদ্ধার করে। উপায়ান্ত না পেয়ে মিত্রজিত সিং ব্রিটিশ কোম্পানির সহযোগিতায় পুলিশ দিয়ে কয়েক বার গগন ও মোহনকে গ্রেফতার চেষ্টা করায়।

 

 

কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায় এবং গগন, মোহন মিত্রজিতদের সৈয়দপুর পরগণার দশ আনা দখল করে নেয়। তারা কৃষকদের নিকট হতে লুফা বা টর্চ সালামী আদায় করে একটি শক্তিশালী বাহিনী গঠন ও সুরক্ষিত দুর্গ নির্মাণ করেন। তৎকালীন জমিদার ইংরেজ সরকারের সৈন্য ও পুলিশ নিয়ে প্রজাদের ওপর নির্যাতন চালাত। ১৮৫৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন বাকেরগঞ্জের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ হ্যারিসন দেশীয় পুলিশ ও একদল ইংরেজ সৈন্য নিয়ে সিংহখালীতে আসেন এবং বর্তমান তেলিখালী ইউনিয়নে অবস্থান করে। সেখান থেকে ঘোড়ায় চড়ে ম্যাজিস্ট্রেট সিংহখালী আসার পথে গগন, মোহন জঙ্গল হতে গুলি করে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের মাথার টুপি উড়িয়ে দেন। এ সময় উভয়পক্ষের মধ্যে তীব্র লড়াই হয়। ফলে ওই সময় গগন, মোহন তাদের বাড়ি ছেড়ে জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। ওই সময় মিঃ হ্যারিসন গগন, মোহনের পরিত্যক্ত বাড়ি যান এবং তাদের বাড়ি যুদ্ধের জন্য সুরক্ষিত দেখে তিনি বিস্মিত হন। যা ১৮৫৪ সালে ২৮ ফেব্রুয়ারি লিখিত পত্রে হ্যারিসন সিংহখালী গমন ও সংঘর্ষের বিবরণ দিয়েছিলেন। হ্যারিসনের পর মিঃ আলেকজান্ডার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে আসেন এবং তিনি গগন ও মোহনকে গ্রেফতার করার জন্য তিন থানার পুলিশ ও শত শত চৌকিদার প্রেরণ করেন।

 

 

তারা পরাজিত হয়ে ফিরে আসে। এ সংবাদে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডার ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েন। তিনি নিজে অনেক পুলিশ ও ইংরেজ সৈন্য নিয়ে দু’মাইল হেঁটে খাল অতিক্রম করে সিংহখালী গমন করেন। তাকে সমর্থন করতে এগিয়ে আসেন মোরেলগঞ্জের মিঃ মোরেল ভ্রাতৃদ্বয় বাহিনী। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে হঠাৎ ঢাল, লেজা নিয়ে গগন, মোহন মিঃ আলেকজান্ডারকে আক্রমণ করে। আবারও উভয়পক্ষের মধ্যে চরম সংঘর্ষ শুরু হয়। এতে ঘটনাস্থলে ১৭ জন বিদ্রোহী কৃষক নিহত হয়। এ সময় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহনের বাড়ি দখল করার চেষ্টা করলে বিদ্রোহীরা ভিতর হতে গুলিবর্ষণ করে। তখন পুলিশ বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তাড়াতাড়ি মোহনের বাড়ি ত্যাগ করে পালিয়ে যান। পালিয়ে যাবার সময় তিনি পুলিশ বাহিনীকে মৃতদেহগুলো আনার নির্দেশ দেন। কিন্তু পুলিশ প্রাণভয়ে পলায়ন করে। গগন, মোহন ১৭ জন বিদ্রোহী কৃষকের মৃতদেহ উদ্ধার করে মোহনের বাড়ির দরজায় কবর দেয়। এখনো তাদের কবরগুলোর সংরক্ষিত রয়েছে।

 

 

ইংরেজ প্রশাসন জমিদারদের সাথে একত্র হয়ে কৃষকদের ওপর অমানুষিক অত্যাচার নির্যাতন করতে থাকলে শেষ পর্যন্ত গগন ও মোহন বৃটিশ সরকারের কোর্টে উপস্থিত হয়। সরকার তাদেরকে ৮টি মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত করে। তৎকালীন বাকেরগঞ্জের জেলার মিঃ স্টিয়ার ১৮৫৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর এবং ১৮৫৫ সালের ৫ জানুয়ারি গগন ও মোহনের বিরুদ্ধে আনীত মামলার রায় দেয় এবং উভয় ভ্রাতাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করে আদালত। উভয় ভ্রাতা ৬০ বছর বেঁচে ছিল এবং ৩০ বছরই কারাগারে ছিল। শেষ জীবনে মুক্তি পেয়ে সিংখালী ফিরে আসে। তাদের বংশধররা ভা-ারিয়া উপজেলার সিংহখালী গ্রামের মিয়াবাড়িতে বাস করছে। গগন ও মোহনের বংশধর জাকির হোসেন মিয়া বলেন, সিংহপুরুষ গগন ও মোহন মিয়া কৃষকদের অধিকার আদায়ে ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও সংগ্রাম করেছে। কিন্তু বিনিময়ে এই বীর যোদ্ধারা রাষ্টের পক্ষ থেকে সামান্য সম্মাননাও পাইনি। আমাদের বাড়ি বহুবার বিভিন্ন সময় সরকারের লোকজন সহ দেশ-বিদেশী সাংবাদিকরা খোঁজ খবর নিতে এসে লেখালেখি করে কিন্তু এ বিষয়টি নিয়ে সরকারের কোন মহত্ব বা সম্মাননার উদ্যোগ আজো দেখিনি।

 

 

 

তিনি আরো বলেন, এই গগন ও মোহন মিয়ার বংশে আল্লাহর ইচ্ছায় ২২ জন ওয়ারিশ এখনো বেঁেচ আছে। তারা বর্তমানে ৬০ বিঘা সম্পত্বির ওপর বসবাস করছেন। এই বংশধরের দাবি, সিংহপুরুষ গগন ও মোহনকে আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রীয় সম্মানা জানানো হউক এবং যোদ্ধার পরিবার হিসেবে তাদেরও মূল্যায়ন করার আহবান করেন। এ বিষয়ে ঐতিহ্যবাহী ভা-ারিয়া শাহাবুদ্দীন ফাজিল (ডিগ্রি) মাদরাসার ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক মো: বশির উদ্দিন জানান, বরিশালের বীর সন্তানরা ইংরেজ শাসন ও তাদের তাবেদার জমিদারদের শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছিলেন। তার মধ্যে সিংহখালী গ্রামের গগন ও মহন মিয়ার বীরত্ব অন্যতম। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ স্বাধীন দেশে সেই আত্মত্যাগী বীর পুরুষরা আমাদের মাঝ থেকে প্রায় বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাচ্ছেন। যোদ্ধা হিসেবে এ সকল সংগ্রামী বীরদের রাষ্ট্রের মূল্যয়ন করা উচিত ছিলো।