রুবেল হোসাইন সংগ্রাম-
মিঠাপুকুর উপজেলা জুড়ে চলছে নামে বেনামে সুদের রমরমা ব্যবসা। ব্যক্তি কেন্দ্রীক এসব সুদের ব্যবসাকে জায়েজ আর প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিতে সুদের টাকা আদায়ে কৌশলে সমবায় সমিতির নাম ভাঙ্গিয়ে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার অনিবন্ধিত সমবায় সমিতি।
এসব সমবায় সমিতির নেই কোন রেজিষ্ট্রেশন, এমনকি রেজিষ্ট্রেশন থাকলেও অধিকাংশগুলো নিয়মনীতি আর সমবায় আইনের তোয়াক্কা না করে বাৎসরিক, মাসিক, দৈনিক, সাপ্তাহিক কার্যক্রমে চালিয়ে যাচ্ছেন সুদের রমরমা ব্যবসা। কৌশলে বিপদগ্রস্ত এসব লোকজনের কাছ থেকে ব্যাংক চেক আর নন-জুডিশিয়াল ফাঁকা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নিয়ে ইচ্ছেমতো সুদের অংক বসিয়ে টাকা উত্তলনে মামলা আর হয়রানি করে আসছেন। সুদের টাকা দিতে না পেরে অব্যাহত চাপে কয়েকটি আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে। ভিটেমাটি ছেড়ে বছরের পর বছর পালিয়ে আছেন অনেকে।
এদিকে বৈরাগীগন্জ বাসষ্টান্ডে একাধিক সমবায় সমিতির অফিস ছাড়াও এমএস- ভ্যারাইটিজ ষ্টোর নামে অনিবন্ধিত সমিতির ভোগ্যপন্য কিস্তিতে নিয়ে বিপাকে ছিন্নমূল মানুষ। মিঠু আর শামীম নামে দুই ভাইয়ের কাছে এমএস ভ্যারাইটিজ স্টোরের সুদে নাজহাল পায়রাবন্দ ইউনিয়নের বাসিন্দারা।
সমবায় সমিতির আড়ালে সুদের ব্যবসায় সবার চাইতে এগিয়ে আছেন ব্যক্তি কেন্দ্রীক সুদ কারবারিরা। নিজেদের সুদের ব্যবসার অংশীদারত্বের প্রভাব বিস্তারে ইচ্ছেমত নিকটাত্মীয়দের নাম দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন নামে সমবায়ের রেজিষ্ট্রেশন নিয়ে সভাপতি /সম্পাদকের পদপদবি ব্যবহার করে কথিত সমবায় সমিতির নাম ভাঙ্গিয়ে ব্যানার, সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে চাকচিক্য অফিস খুলে কর্মী নিয়োগ দিয়ে নানান অজুহাতে বিভিন্ন প্রলোভনে ধরাশায়ী করছেন সাধারণ মানুষজনকে। প্রভাব বিস্তারে তাদের সহযোগিতা করছেন বিভিন্ন মাদকাসাক্ত আর চাঁদাবাজরা। এতে মারপিট ও হামলার শিকার হচ্ছেন অনেকে।
উপজেলা সমবায় অফিসের তথ্যমতে- মিঠাপুকুর সমবায় অফিসের নিবন্ধিত সমবায় সমিতির সংখ্যা ৫৩০ টি, তারমধ্যে ২৩৪ টি সমবায় সমিতির কার্যক্রম সচল রয়েছে। বাকী ২৯৬ টি সমবায় সমিতির কোন কার্যক্রম নেই। কার্যক্রম না থাকায় এসব সমিতির রেজিষ্ট্রেশন বাতিলের জন্য জেলা সমবায় অফিসে তালিকা পাঠানো হয়েছে। কিন্তু মিঠাপুকুর উপজেলার বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে আর বিভিন্ন সমবায় সমিতির তথ্যমতে মিঠাপুকুরে প্রায় ২৫০০ সমবায় সমিতি সচল রয়েছে। রেজিষ্ট্রেশন বিহীন এসব সমিতি নিয়মিত কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। সমবায় সমিতি লিঃ হলেও তাদের কার্যক্রমে মূলত প্রকাশ্যে সুদ কারবারের তথ্য পাওয়া যায়। এমনকি ১০০০ টাকায় ২০০ টাকা মাসিক সুদ আদায় করা হয় বলে অভিযোগ করেন অনেক।
করোনাকালীন সময়ে মানুষকে নিত্য প্রয়োজনীয় পন্যসামগ্রি দেওয়ার নামে মাঠে অগনিত সমবায় সমিতি। স্বল্প আয়ের লোকজনকে চালের বস্তা, আটা, ময়দা, তেল, সাবান, ডাল, গ্যাস সিলিন্ডার দেওয়ার নামে মোটা অংকের সুদে রমরমা বানিজ্য করে হাতিয়ে নেয় লক্ষ লক্ষ টাকা। এসব সমিতির তালিকায় আশার আলো, আলোর পথিক, আলোর দিশারি, প্রত্যাশা, অনির্বাণ, সেবা ভোগ্যপন্য বিতরন সমবায় সমিতি নামে একাধিক সমিতি মিঠাপুকুরে এখনো মাঠে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে আসছে।
এসব সমিতির অফিস ঘুরে পাওয়া যায়নি কোন প্রয়োজনীয় কাগজ পত্রাদি। উপজেলার জায়গীর আর বৈরাগীগন্জে কয়েকটি সমবায় সমিতির অফিসে প্রবেশের চেষ্টা করলেও সেসব অফিস তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। ০২ নং রানীপুকুর ইউনিয়নের এরশাদ মোড় সংলগ্ন পথের দিশারি সমবায় সমিতি লিঃ এর প্রধান কার্যালয়ে গেলে ম্যানেজার জানান, তাদের সমিতির চেয়ারম্যান মনোয়ার হোসেনের সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু একাধিকবার যোগাযোগ করেও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। এমনকি বালুয়ায় পথের দিশারি সমবায় সমিতি লিঃ নামে তাদের আরেকটি শাখায় গেলেও কর্মরত কেউ সঠিক কোন তথ্য দিতে পারেনি।
সমবায়ের আড়ালে ‘সংস্থা’ নামেও রয়েছে একাধিক সামাজিক প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন সামাজিক আর সমাজ সেবার আড়ালে স্বাস্থ্য সেবা, চিকিৎসা সেবা, আইনি সেবা, শিক্ষা কার্যক্রম, হস্ত ও কুটির শিল্পে উদ্যোক্তা তৈরিসহ কৃষি সেবা দেয়ার নামে চলছে নানাবিধ প্রতারণা। স্বল্প মূল্যে এসব সেবা পাওয়ার আশায় আর কর্মসংস্হানের নামে কয়েক লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়ে প্রায়ই পালিয়ে যাচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠান। দু- একজন প্রতারক আইনি ঝামেলায় জড়িয়ে গেলেও জামিনে বেরিয়ে এসে নিত্যনতুন পন্থা অবলম্বন করে এসব সমিতির কার্যক্রম চলমান রেখেছেন।
উপজেলা সমবায় অফিস কিভাবে এসব সমবায় অফিসের নিবন্ধন দিচ্ছেন? আর কিভাবে চলছে তাদের এসব অবৈধ কার্যক্রম তা নিয়ে নানান অভিযোগ স্বয়ং বিভিন্ন সমবায় সমিতির সদস্যদের। মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর দাবি, উপজেলা সমবায় অফিস সঠিক তদারকি করতে না পারলে সমবায় সমিতির আড়ালে এসব সুদের ব্যবসার লাগাম টেনে ধরা অসম্ভব হয়ে পড়বে। এ বিষয়ে রংপুর জেলা জজ কোর্টের আইনজীবী কামরুল আহসান রিজভী জানান, সমবায় আইন সম্পর্কে যথাযথ ধারনা আর আইনের প্রয়োগ না থাকায় বাড়ছে সমবায় সমিতির সংখ্যা। নিয়মিত মনিটরিং করে তাদের বিষয়ে খোঁজ খবর রাখতে হবে।
মিঠাপুকুর উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা মাহবুবুল ইসলাম, সমবায় অধিদপ্তরের মিটিংগে ঢাকায় অবস্থান করায় তিনি অফিস সহকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বললে সহকারী পরিদর্শক চন্দন কুমার সরকার জানান, অনিবন্ধিত সমিতির বিষয়ে কেউ কোন অভিযোগ করলে আমরা ব্যবস্হা নিয়ে থাকি। অকার্যকর সমিতির বিষয়ে আমরা তালিকা প্রেরণ করেছি। আর যারা সমবায় আইনের তোয়াক্কা করছেনা, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্হা নেওয়া হবে। কিভাবে সমবায় সমিতির নাম ভাঙ্গিয়ে হাজার হাজার সমবায় সমিতি চলছে জানতে চাইলে তিনি, উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। সচেতন মহলের দাবি, এসব সমবায় সমিতির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্হা নেওয়া হউক, এবং প্রকৃত সমবায় সমিতির সদস্যদের নানাবিধ প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করা হউক।