নিজস্ব প্রতিনিধিঃ
ময়মনসিংহ শহরের প্রানকেন্দ্র ময়মনসিংহ রেল স্ট্রেশন থেকে মাত্র দু-কদম দুরে গাঙ্গিনারপাড় এলাকায় অবস্থিত ময়মনসিংহ পতিতা পল্লি। প্রায় ২শ' বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এ যৌন পল্লিতে প্রতিদিন অন্তত ৬ শতাধিক খদ্দেরই আসে। তাদের অধিকাংশের বয়স ১৭ থেকে ১৯ বছর। এদের মধ্যে বেশির ভাগ ছাত্র। কেউ আবার কর্মজীবী। বিপরীতে বেশির ভাগ যৌনকর্মী মধ্যবয়সী। তাদের বয়স ৩০ থেকে ৫০-এর মধ্যে। টিনএজদের পছন্দের তালিকায় মধ্যবয়সীদের সংখ্যাই বেশি বলে দাবি যৌনকর্মীদের। সরজমিনে ময়মনসিংহের পতিতা পল্লীতে গেলে এ তথ্য পাওয়া যায়।
এখানে রয়েছে বিভিন্ন বয়সী প্রায় ৩৫০ থেকে ৪০০ যৌনকর্মী। অন্যদিকে প্রতিদিন গড়ে ১০০০ খদ্দেরের আনাগোনা থাকে এ পল্লীতে। এর বাইরে পতিতা পল্লীতে আসেন প্রায় ২ শতাধিক দর্শনার্থী। তারা পল্লীর এ মাথা থেকে ও মাথা ঘুরে বেড়ায়। বিকাল থেকে জমে ওঠে ভিড়। যৌনকর্মীরা জানান, তাদের পিকটাইম সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত। দিনের বেলায় খদ্দেরের আনাগোনা থাকলেও তুলনামূলক কম। তবে সকাল ৮টা থেকে শুরু হয় পতিতা পল্লীর কাজ। চলে টানা রাত ১১টা পর্যন্ত। এরপর বন্ধ করে দেয়া হয় পল্লীর দুই পাশের দুই গেইট। সেখানে পাহারায় থাকে বেতনভোগী দারোয়ান। তবে তখনও বন্ধ থাকে না ব্যবসা। যৌনকর্মীদের ভাষায়, তাদের পল্লীতে আসেন দুই ধরনের খদ্দের।
অস্থায়ী আর স্থায়ী। যারা কিছু সময়ের জন্য আসেন তারা অস্থায়ী। আর যারা সারা রাত বা সারাদিনের জন্য আসেন তারা স্থায়ী। স্থায়ী খদ্দেরের সংখ্যা একেবারে কম নয় বলে দাবি তাদের। সরজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, যৌনকর্মীদের রয়েছে ছোট ছোট নিজস্ব ঘর। একেক ঘর একেক জনের নামে পরিচিতি। কোন কোন ঘরে টাঙানো রয়েছে পতিতার বাঁধাই করা বড় ছবি। খদ্দেরদের জন্য রয়েছে মদের দোকান। শুধু বাংলা মদ মেলে এখানে। তবে ইচ্ছা করলে কেউ বাইরে থেকেও নিয়ে যেতে পারেন বিদেশী বা দেশী মদ। প্রায় ৩৫০-৪০০ পতিতা নিয়ন্ত্রণ করেন ৪০ জন সর্দারনী।
ছোট ছোট এসব ঘর সর্দারনীরা দৈনিক ভিত্তিক ভাড়া নিয়ে থাকেন। ঘরের মূল মালিককে দেয়া হয় ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। বেশির ভাগ সর্দারনী আবার ভাড়া দেন নিয়ন্ত্রণে থাকা পতিতাদের কাছে। তাদের কাছ থেকে আদায় করা হয় দৈনিক ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। এদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কথা চিন্তা করে সম্প্রতি যৌনকর্মীরা তাদের রেট বাড়িয়েছেন বলে জানান। আগে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা খদ্দেরের কাছ থেকে নেয়া হতো। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০০-৫০০ টাকায়। তবে দীর্ঘদিন ধরে পল্লীতে যাতায়াত আছে এমন খদ্দেরের কাছ থেকে নেয়া হয় আগের রেটই। একই ভাবে বেড়েছে স্থায়ী খদ্দেরদের রেট। আগে সারা রাত বা সারা দিনের জন্য নেয়া হতো ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকা।
এখন নেয়া হয় ২০০০ থেকে ২৫০০ টাকা। এদিকে পতিতা পল্লী নিয়ন্ত্রণে ২০০১ সাল থেকে রয়েছে সুখতারা কল্যাণ সংস্থা নামে একটি সংগঠন। এতে রয়েছে ১১ সদস্যের নির্বাচিত কমিটি। ২ বছর পরপর যৌন কর্মীদের সরাসরি ভোটে এ কমিটি নির্বাচন করা হয়। বর্তমানে সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন লাভলী। প্রায় ২৫ বছর ধরে এ পল্লীতে তার বসবাস। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন রুমানা আক্তার রুমা। সহ-সভাপতির পদে রয়েছেন হাসনা হেনা। কমিটির কার্যক্রম সম্পর্কে লাভলী বলেন, পতিতা পল্লীর যৌন কর্মীদের অধিকার আদায়ে তারা শক্ত ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেন। এছাড়া যে কোন ধরনের সমস্যা কিংবা সচেতনতামূলক কার্যক্রমে সংস্থা তাদের পাশে দাঁড়ায়। তিনি বলেন, আগে কোন সংস্থা বা কমিটি না থাকায় যৌন কর্মীরা ছিলেন অসহায়। যে যেমন পেরেছেন আমাদের ব্যবহার করেছেন।
এখন সময় পাল্টেছে। অনেকটা ঘুরে দাঁড়িয়েছি। নিজেদের পেশাকে করেছি নিরাপদ। এদিকে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে একাধিকবার পল্লীর কার্যক্রম বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। শেষ পর্যন্ত তা কার্যকর করতে পারেনি প্রশাসন। এ পসঙ্গে সংস্থার সভাপতি লাভলী বলেন, আমরা সেক্স করে জীবিকা নির্বাহ করছি। যতদিন ভাল লাগবে এ পেশায় থাকবো। পল্লী বন্ধ করে দেয়া হলে আমরা ছড়িয়ে পড়বো শহর থেকে গ্রামে। তখন পরিবেশ নষ্ট হবে।
প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, এখন প্রতিদিন যে এক হাজার মানুষ এখানে এসে তাদের যৌন চাহিদা মেটাচ্ছে তখন তারা কোথায় যাবে? তিনি বলেন, প্রশাসন যদি উচ্ছেদ করে তাহলে সমাজে তীব্র নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ধর্ষণ বাড়বে। মেয়েঘটিত অনাচার দেখা দেবে। সমাজপতিরা যদি এসবের পক্ষে থাকেন তাহলে আমাদের বলার কিছুই নেই। ৭০০ টাকায় মেলে রেজিস্ট্রেশন: দুই পুলিশ কর্মকর্তার গ্রীন সিগন্যাল আর ৭০০ টাকা দিলেই মেলে পতিতার রেজিস্ট্রেশন নাম্বার। এর আগে নতুন প্রতি মেয়ের জন্য পুলিশ কর্মকর্তাদের দিতে হয় ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা। মেয়েদের পক্ষে এ টাকা পরিশোধ করেন সর্দারনীরা। পরে ওই টাকা আদায় করা হয়।
এদিকে শহরের বেশির ভাস ভাসমান পতিতা এখন আশ্রয় নিয়েছেন এ পল্লীতে। ভাসমান থাকলে তাদের জীবন ও পেশা থাকে অনিশ্চিত আর ঝুঁকির মধ্যে। নাম অনিচ্ছুক এক সর্দারনী জানান, দালাল বা অন্য কোনভাবে নতুন কেউ এ পেশায় আসতে চাইলে প্রথমে তাকে নেয়া হয় শহরের ১নং পুলিশ ফাঁড়ির টিএসআই-এর কাছে। তিনি মেয়ের সাক্ষাৎকার নেন। বয়স, ঠিকানা এসব জেনে বৈধ মনে করলে তিনি নিয়ে যান কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)-র কাছে। তার গ্রীন সিগন্যাল পেলেই ওই মেয়েকে নেয়া হয় আইনজীবীর কাছে।
এরপরই এফিডেভিটের মাধ্যমে পতিতা হিসেবে রেজিস্ট্রেশন করা হয়। বেশ ক’জন সর্দারনী বলেন, পুলিশের গ্রীন সিগন্যাল পেতে খরচ করতে হয় প্রায় ৪০০০ টাকা। কালো মেয়ে হলে পুলিশকে দিতে হয় ২০০০ টাকা। আর সুন্দর চেহারার মেয়ের জন্য খরচ হয় ৪০০০ টাকা। এক্ষেত্রে বয়সের বিষয়টিকে খুব একটি গুরুত্ব দেয়া হয় না। ১৮ বছর পেরিয়েছে কিনা তা যাচাইও করা হয় না। বেশির ভাগ সর্দারনী দাবি করেছেন অপ্রাপ্তবয়স্ক কোন পতিতা এ পল্লীতে নেই। বাড়ছে সচেতনতা: পতিতারা এখন অনেক সচেতন বলে জানালেন সংশ্লিষ্টরা।
আগে অনিয়ন্ত্রিত যৌন মিলন ছিল সাধারণ রেওয়াজ। বিশেষ করে কনডম ববহারের মাত্রা ছিল অনেক কম। এখন তা বেড়েছে। পাশাপাশি খদ্দেররাও সচেতন হয়েছেন বলে তাদের দাবি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক যৌনকর্মী বলেন, সবাই আমাদেরকে খারাপ মনে করে। কেও আমাদের খবর রাখেনা। আমরা অনেক কষ্ট করছি, মানবেতর জীবন য্পন করছি। স্থানীয় নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা যদি আমাদের একটু সহায়তা করতো হয়তো আমাদের অনেক উপকার হতো।
প্রকাশক ও সম্পাদক মোঃ গোলাম মাওলা শাওন ০১৭১১-০০৬২১৪, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক 01762119992, প্রধান কার্যালয় ৩৪ নুরজাহান শরীফ প্লাজা ৮ম তলা, পুরানা পল্টন ঢাকা ১০০০। ০১৯৯৯-৯৫৩৯৭০ নিউজ ই-মেইল [email protected] সিভি পাঠান: [email protected]