মোঃ গোলাম মোস্তফা, চিরিরবন্দর (দিনাজপুর) প্রতিনিধিঃ-
সংগঠক মাহফুজুল হক আসাদ বলেন, ‘এই উপজেলায় সম্প্রতি আশঙ্কাজনক হারে আত্মহত্যার ঘটনা বেড়েছে। সামাজিক বৈষম্য, পারিবারিক কলহের কারণেই বেশির ভাগ আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে।’
দিনাজপুর শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণে চিরিরবন্দর উপজেলা। শিক্ষানগরী হিসেবেও এ উপজেলার বিশেষ সুনাম রয়েছে। তবে উদ্বেগের কারণ হয়েছে এই এলাকার একের পর এক আত্মহত্যার ঘটনা।
পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, গত এক বছরে এই উপজেলায় আত্মহত্যা করেছেন অন্তত ৪১ জন। আর বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যাটি প্রায় ১০০।
পুলিশের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ মাসে এই উপজেলায় আত্মহত্যা করেছেন ১৫ জন। এর মধ্যে ১৫ সেপ্টেম্বর অমরপুর ইউনিয়নের সন্তোষপাড়ায় সপ্তম শ্রেণির ছাত্র আল-আমিন গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে। পরদিনই একই ইউনিয়নের বাসুদেবপুর গ্রামে গলায় ফাঁস দেয় শ্যামলী রায় নামে সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রী।
এভাবে একে একে সেপ্টেম্বরে ফতেজৎপুর ইউনিয়নের দশম শ্রেণির সাবিনা, অক্টোবরে উপজেলা সদরে ১৮ বছরের এক কিশোর, আব্দুলপুর ইউনিয়নের নান্দেড়াই গ্রামে অষ্টম শ্রেণির ববিতা রানী রায়, আব্দুলপুর ইউনিয়নের দীঘারণ গ্রামের দশম শ্রেণির শামীমা আক্তার সুমি আত্মহত্যা করেন বলে উল্লেখ আছে।
নভেম্বরে ফতেজৎপুর ইউনিয়নে শরিফা বেগম নামে এক গৃহবধূ ছাড়াও অমরপুর ইউনিয়নে মোছাব্বের আলী নামে ৬৬ বছরের এক ব্যক্তি আত্মহত্যা করেন। এ মাসেই আব্দুলপুর ইউনিয়নের বটতলা গ্রামে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সফিকুলও আত্মহত্যা করে।
ডিসেম্বরে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে আউলিয়াপুর ইউনিয়নের নয়ন ইসলাম ও উপজেলার একটি বিদ্যালয়ের আবাসিক হলের ছাত্র রাসেল। তারা দুজনই দশম শ্রেণিতে পড়ত। একই মাসে আউলিয়াপুকুর ইউনিয়নে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী রাবেয়া বেগমও আত্মহত্যা করে।
জানুয়ারিতে উপজেলার আমবাড়ী এলাকার আব্দুল্লাহ নামে ৪৬ বছরের এক ব্যক্তি এবং নান্দেড়াই গ্রামের ৩৩ বছরের গৃহবধূ ফাতেমা বেগম আত্মহত্যা করেন। একই মাসে উপজেলার সরকারি কলেজ এলাকায় ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দেন সমিনা বেগম নামে ৬৫ বছরের এক নারী। তবে সেখানকার স্থানীয়দের কারণে তিনি বেঁচে যান।
এ ছাড়া ফেব্রুয়ারিতে উপজেলার আউলিয়াপুর ইউনিয়নের গলাহার দুর্গাতলীতে ডলী রানী নামে ৩৫ বছর বয়েসী এক গৃহবধূ আত্মহত্যা করেন।
পুলিশের দেয়া পরিসংখ্যানের চেয়ে চিরিরবন্দরে আত্মহত্যা করা মানুষের প্রকৃত সংখ্যাটি আরও বেশি বলে দাবি করছে ‘পাশে দাঁড়াও’ নামে একটি স্থানীয় সামাজিক সংগঠন। তবে দুই পক্ষই জানিয়েছে, আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে বেশির ভাগই ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সী। তারা বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী।
আত্মহত্যার চেষ্টা করে বেঁচে যাওয়া ১৮ বছরের এক কিশোর নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলে, ‘আমি গত বছরের মাঝামাঝি গলায় দড়ি দিয়ে বাড়িতে আত্মহত্যার চেষ্টা করি। কিন্তু সে সময় পরিবারের লোকজন আমাকে বাঁচায়। তার পরও আমাকে ১০ দিনের মতো হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয়েছিল।’
ওই কিশোর জানায়, দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে সে সবার ছোট। বোনের বিয়ে হয়েছে। বড় ভাইও বিয়ে করে অন্যত্র বাস করছেন। বয়স্ক বাবা অন্যের জমি বর্গা নিয়ে কৃষি কাজ করে তার পড়াশোনা চালিয়ে নিচ্ছিলেন।
এইচএসসি পর্যন্ত পড়েই পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায় তার। ততদিনে তার বাবার শরীরেও নানা রোগ বাসা বাঁধে।
কিশোরটি বলে, ‘ঠিকমতো নিজের চিকিৎসা না করে তিনি আমার পড়ালেখা চালিয়েছেন। এসব দেখে সন্তান হিসেবে আমার বেঁচে থাকা, কষ্টের ছাড়া কিছুই ছিল না। তাই আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলাম। তবে এখন আমি নিজেই একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করে বাবার চিকিৎসা করাচ্ছি।’
নাম প্রকাশ না করে আত্মহত্যার চেষ্টাকারী এক কিশোরী বলে, ‘করোনার সময় স্কুল-কলেজ বন্ধ ছিল। বাড়িতে বসে বসে আর ভালো লাগছিল না। তাই বাবাকে একটি মোবাইল ফোন কিনে দিতে বলি। কিন্তু বাবা আমাকে মোবাইল কিনে না দিয়ে উল্টো অনেক কথা শুনিয়েছেন। তাই আমি বিষ খেয়েছিলাম।’
চিরিরবন্দরে আত্মহত্যার হার কমিয়ে আনতে মার্চে সাইকেল প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে যাচ্ছে ‘পাশে দাঁড়াও’ সংগঠনটি। এর প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক মাহফুজুল হক আসাদ বলেন, ‘এই উপজেলায় সম্প্রতি আশঙ্কাজনক হারে আত্মহত্যার ঘটনা বেড়েছে। সামাজিক বৈষম্য, পারিবারিক কলহের কারণেই বেশির ভাগ আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে।’
তিনি জানান, সাইকেল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী সবাই আত্মহত্যা প্রতিরোধে উপজেলার সব স্কুল-কলেজে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলবে।
চিরিরবন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বজলুর রশীদ বলেন, ‘এ উপজেলায় এক বছরে ৪১ জন আত্মহত্যা করেছে। এর মধ্যে অধিকাংশের মরদেহ ময়নাতদন্ত ছাড়াই পরিবারকে হস্তান্তর করা হয়েছে।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আয়েশা সিদ্দীকা বলেন, ‘প্রতি মাসে উপজেলা পরিষদে একটি করে মাসিক সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় উপজেলার সব অফিসের প্রধানরা উপস্থিত হন। আমি সেই সভায় আত্মহত্যা প্রতিরোধের বিষয়ে কথা বলেছি। আত্মহত্যার প্রবণতা কেন বাড়ছে, তা খুঁজে বের করতে কমিটির সদস্যদের নির্দেশনা দিয়েছি।
‘এ ছাড়া উপজেলার সব মসজিদের ইমাম ও মন্দিরের পুরহিতদের আত্মহত্যার বিষয়ে কথা বলার জন্য বলেছি। এ উপজেলায় আত্মহত্যার প্রবণতা কমিয়ে আনতে সব ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তারা নিজ নিজ নির্বাচিত এলাকায় গিয়ে আত্মহত্যা প্রতিরোধে জনসচেতনতা সৃষ্টি করবেন। প্রয়োজনে তারা উঠান বৈঠক করে আত্মহত্যার কুফল সম্পর্কে জানাবেন।’
প্রকাশক ও সম্পাদক মোঃ গোলাম মাওলা শাওন ০১৭১১-০০৬২১৪, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক 01762119992, প্রধান কার্যালয় ৩৪ নুরজাহান শরীফ প্লাজা ৮ম তলা, পুরানা পল্টন ঢাকা ১০০০। ০১৯৯৯-৯৫৩৯৭০ নিউজ ই-মেইল [email protected] সিভি পাঠান: [email protected]