রাবি প্রতিনিধি:
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় প্রক্সি দিয়ে ৪ শিক্ষার্থীর ভর্তি হওয়ার প্রমাণ মিলেছে। ৩ থেকে ৮ লক্ষ টাকার বিনিময়ে জালিয়াতি করে তারা ভর্তি হয় বলে এক সূত্র জানিয়েছে। ভর্তীকৃত এসব শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃথক পৃথক বিভাগের তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত আছেন। আশ্চর্য তথ্য হলো এই চার শিক্ষার্থীর হয়ে ভর্তি পরীক্ষায় বসেছেন একই প্রক্সিদাতা। এক অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
এই চার শিক্ষার্থীর মধ্যে একজনের বিভাগ সম্পর্কে জানা সম্ভব হয়নি। বাকি তিনজন হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস’ বিভাগের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান সনি, আইন বিভাগের ফাহিম আল মামুন বর্ণ, ফিজিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড স্পোর্টস সায়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থী মো. শোভন। বর্ণ রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি এবং শোভন রাবি ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি গোলাম কিবরিয়ার ভাতিজা। তবে দুর্ধর্ষ এই প্রক্সিদাতার পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ছাত্রলীগের এক নেতা বলেন, প্রক্সির সহায়তায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শিক্ষাবর্ষে অন্তত ২০-২৫ জন করে শিক্ষার্থী ভর্তি করাতেন ফোকলোর বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ও রাবি শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মুশফিক তাহমিদ তন্ময়। প্রক্সির জন্য নিতেন শিক্ষার্থী প্রতি ৩ থেকে ৮ লক্ষ টাকা। প্রক্সির গডফাদার হিসেবে খ্যাত এই তন্ময়কে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন রাবি প্রশাসন। পরে প্রক্সির সাথে জড়িত থাকার সুস্পষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে গত বছরের ৪ অক্টোবর রাজশাহী মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল তাকে গ্রেফতার করেন। বর্তমানে তিনি জামিনে আছেন বলে জানা গেছে। তার বক্তব্য জানতে মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, দিনটি ছিল ২০২১ সালের ৬ অক্টোবর। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার তৃতীয় শিফটে ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া অ্যাকাডেমিক ভবনের ৩১১ নম্বর রুমে মেহেদী হাসান সনির হয়ে প্রক্সি দিয়েছিলেন প্রক্সিদাতা। অ্যাডমিট কার্ডে নিখুঁত কারসাজির কৌশলে পরীক্ষার হলে থাকা দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকদের চোখ এড়াতে সক্ষম হন প্রক্সিদাতা। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ৭২ দশমিক ৬৫ নম্বর পেয়ে ১৬তম মেধা স্থান অর্জন করেন সনি। তার রেজিস্ট্রেশন নাম্বার ২১১০৩৩৩১৭০ এবং পরীক্ষার রোল নাম্বার ৯৬১১৫। নওগাঁ জেলার পত্নীতলা উপজেলার কমলাবাড়ি গ্রামে তার বাসা। বাবার নাম মো. আব্দুল গফুর মন্ডল ও মাতা মোসা. লায়লি বিবি।
বর্তমানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস’ বিভাগের তৃতীয় বর্ষের একজন শিক্ষার্থী। ভর্তি পরীক্ষার অ্যাডমিট কার্ডের ছবির সাথে সনির নিজের চেহারার কোনো মিল পাওয়া যায়নি। পরীক্ষার হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকরা যাতে প্রক্সির বিষয়টা বুঝতে না পারেন তার জন্যই সনির ছবির পরিবর্তে অ্যাডমিট কার্ডে সংযুক্ত করা হয় প্রক্সিদাতার ছবি। তাতে সফলও হন তারা।
এ বিষয়ে মেহেদী হাসান সনি বলেন, আমি এসবের মধ্যে নেই। পড়াশোনা ও ক্যাম্পাস ছেড়ে একটি হোটেলে কাজ করছি। দুই বার ড্রপ আউট হয়ে আমি ক্যাম্পাস ছেড়েছি। তবে আমি ও ধরনের কিছু করিনি। সব ডকুমেন্ট আমার কাছে আছে। আমি ষড়যন্ত্রের শিকার। আগেও এসব নিয়ে কথা উঠেছিল।’ তবে পরে তার কাছে এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত চাইলে তিনি দিতে পারেননি। এ প্রতিবেদকের কাছে থাকা কাগজপত্র তাকে দিলে তিনি পরে আর বিষয়টি নিয়ে কথা বলেননি।
অন্যদিকে প্রক্সিদাতার সহযোগিতায় ফাহিম আল মামুন বর্ণ নামের এক শিক্ষার্থী ‘এ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ৮২.৬০ স্কোর করে ৪৬তম মেধা স্থান অর্জন করে ভর্তি হন আইন বিভাগে। তার রেজিস্ট্রেশন নাম্বার ২১১০২১৬১২৬ এবং রোল নাম্বার ৫৪১৩৭। তার বাসা রাজশাহী নগরীর রাজপাড়া উপজেলার দাশপুকুর গ্রামে। বাবার নাম মো. মামুনার রশিদ ও মায়ের নাম ফজিলাতুন নেছা। বর্তমানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত। তিনি রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগের সহ-সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। বক্তব্য জানতে তার মোবাইল ফোনে কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
একই পন্থা অবলম্বন করে ‘সি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ৭৯ দশমিক ৭০ নাম্বার পেয়ে ২২তম মেধা স্থান অর্জন করেন মো. শোভন। তার রেজিস্ট্রেশন নাম্বার ২১১০৯২৯১১২ এবং রোল নাম্বার ৭১১০৬। বর্তমানে তিনি ফিজিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড স্পোর্টস সায়েন্স বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি রাজশাহীর মতিহার থানার বুধপাড়া গ্রামের মো. গোলাম সারওয়ার ও মোসা. সেলিনা বেগমের পুত্র। তিনি রাবি শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি গোলাম কিবরিয়ার ভাতিজা। তবে শোভনের মোবাইল ফোনে কয়েকবার কল দেওয়া হলেও বন্ধ পাওয়ায় তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
অবাক করার বিষয় হলো যে প্রক্সিদাতা সনির হয়ে পরীক্ষা দিয়েছিলেন ওই একই প্রক্সিদাতা বর্ণ ও শোভন ও মো. মিরাজুল ইসলাম শাওন (রোল: ৭০৩৫৯) নামের এক শিক্ষার্থীর হয়ে পরীক্ষা দিয়েছিলেন। তবে মূল পরীক্ষার্থীর শরীরের গঠনের সাথে মিল রেখে অ্যাডমিট কার্ডে ছবি এডিট করা হয়েছে। কারো অ্যাডমিট কার্ডে এডিট করে ছবি মোটা করে দেওয়া হয়েছে আবার কারো ক্ষেত্রে চিকন করে দেওয়া হয়েছে।
সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও বর্তমানে ‘এ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার সমন্বয়ক অধ্যাপক ড. এস. এম. এক্রাম উল্যাহ বলেন, এই ঘটনাটা আমার সময়ের না। তবে ভর্তি পরীক্ষায় কেউ জালিয়াতি করলে কোনো প্রকার ছাড়া পাবে না। বিষয়টা তদন্ত হওয়া উচিত। এটা যদি সঠিক হয় তাহলে মাননীয় উপাচার্য হাতে শক্তি সেটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষার সভাপতি অধ্যাপক মো. সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, যদি প্রমাণিত হয় যে ওই শিক্ষার্থীরা অসদুপায় অবলম্বন করেছেন তাহলে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনানুগ শাস্তি হবে। যেকোনো কাজ করতে গেলে ত্রুটি বিচ্যুতি হতে পারে। সেসময় হয়তো তাদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি, তবে এখন যেহেতু অভিযোগটা উঠেছে তাহলে এটার তদন্ত করে প্রমাণিত হলে শাস্তির আওতায় আনা উচিত।
সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সালেহ হাসান নকীব বলেন, অভিযোগটা যদি ডকুমেন্টেড ও প্রমাণিত হয় তাহলে তাহলে আমাদের প্রশাসন কড়া পদক্ষেপ নেবেন। কোনো প্রকার নমনীয়তা বা দ্বিধাদ্বন্দ্বের ভিতরে যাব না।