ফাহাদ মোল্লা
এক সময়ের সজীব, প্রাণোচ্ছল বাড্ডা-সাতারকুলের খাল আজ দখল আর দূষণের বিষাক্ত ছোবলে বিলীন হওয়ার পথে। শুধু একটি জলপথ নয়, ছিল এ অঞ্চলের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ধানক্ষেতে সেচ, মাছ ধরা, সাঁতার প্রতিযোগিতা, নৌকা বাইচ—সবকিছুর প্রাণকেন্দ্র ছিল এই খাল। কালের বিবর্তনে সেই সোনালী অধ্যায় আজ শুধুই স্মৃতি, আর বাস্তবতা এক করুণ পরিণতি।
প্রবীণদের বর্ণনায় ভেসে ওঠে খালের উচ্ছ্বাসময় দিনগুলো। বর্ষায় দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসত নৌকা বাইচের উন্মাদনা দেখতে। শিশু-কিশোরদের সাঁতার প্রতিযোগিতায় মুখরিত হতো খালের পাড়। কৃষকদের কাছে এটি ছিল ‘জলবাহিত আশীর্বাদ’, যা ফসলের মাঠে আনত শস্যশ্যামল ছোঁয়া। খালকেন্দ্রিক জীবনধারা ছিল এ অঞ্চলের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।
বর্তমান চিত্র ভয়াবহ। কোথাও খাল চাপা পড়েছে বহুতল ভবনের নিচে, কোথাও তা পরিণত হয়েছে দুর্গন্ধময় আবর্জনার ভাগাড়ে। স্থানীয়দের ভাষ্যে, খাল দখলের প্রক্রিয়া চলে সুপরিকল্পিতভাবে। প্রথমে পাড়ে ফেলা হয় আবর্জনা, পরে ভরাট করে তৈরি হয় টয়লেট বা রান্নাঘর। ধীরে ধীরে টিনের ঘর, গ্যারেজ বা দোকান, আর সবশেষে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় বহুতল পাকা দালান। বিস্ময়কর হলেও সত্য, এসব দখলকৃত জায়গা এখন বৈধ দলিলে রেজিস্ট্রি হয়ে গেছে—যেন খালের কোনো অস্তিত্বই কখনো ছিল না।
খাল একসময় ছিল জলাবদ্ধতা নিরসনের নির্ভরযোগ্য পথ। কিন্তু আজ খালের অভাবে সামান্য বৃষ্টিতেই হাঁটুপানি জমে যায়। রাস্তাঘাট ডুবে গিয়ে যানচলাচল ব্যাহত হয়। স্থানীয় বাসিন্দা তারেক মিয়ার আক্ষেপ, *“আগে মাছ ধরতাম, এখন মশা ধরতে হয়। খাল ছিল আশীর্বাদ, এখন অভিশাপ।
সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা কিংবা ভূমি অফিস- কোনো সংস্থা কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি। মাঝে মাঝে লোক দেখানো অভিযান চালানো হলেও কিছুদিন পরই সবকিছু আগের অবস্থায় ফিরে আসে। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা জরিপ ও ছবি তোলায় সীমাবদ্ধ থাকেন, অথচ স্থানীয়দের দাবি অনুযায়ী খালের ৫০ শতাংশেরও বেশি ইতিমধ্যেই বেদখল হয়ে গেছে।
বাড্ডা-সাতারকুলের খাল কেবল একটি জলাধার নয়, এটি পরিবেশগত, সামাজিক ও ঐতিহাসিক সম্পদ। এখনই সম্মিলিত উদ্যোগ না নিলে এটি পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। সরকার, সিটি কর্পোরেশন এবং পরিবেশবাদীদের ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপই পারে খালকে পুনরুদ্ধার করতে। নইলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে—নদীমাতৃক দেশের সন্তান হয়েও আমরা নিজেদের খাল বাঁচাতে পারিনি