ঢাকা , মঙ্গলবার, ০৮ এপ্রিল ২০২৫ , ২৪ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গাজার মৃত্যু, উম্মাহর কলঙ্ক


আপডেট সময় : ২০২৫-০৪-০৬ ২২:১৬:২০
গাজার মৃত্যু, উম্মাহর কলঙ্ক গাজার মৃত্যু, উম্মাহর কলঙ্ক



 
মোঃ আব্দুল্লাহ আল মুকিম রাজু 

ইতিহাস কখনো কাউকে ক্ষমা করে না। সময়ের পাতায় কিছু মুহূর্ত থাকে, যেগুলো জাতির আত্মার আয়না। গাজা এমনই এক অধ্যায়—যেখানে শিশুদের কান্না আর মানুষের রক্তে লেখা হলো মুসলিম বিশ্বের নপুংসকতা, নিষ্ক্রিয়তা আর নির্লজ্জ নিরবতা।

একটি জ্বলন্ত প্রশ্ন: উম্মাহ কোথায়?

আজ বিশ্বে প্রায় ৫৮টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ রয়েছে। মুসলমানদের মোট জনসংখ্যা প্রায় ২০০ কোটির কাছাকাছি। তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ, সামরিক বাহিনী সমৃদ্ধ, পারমাণবিক অস্ত্রধারী এমন অসংখ্য দেশ—তবুও গাজার ছোট্ট ভূখণ্ডটির পক্ষে দাঁড়াতে পারেনি কেউ।

পাকিস্তান – পারমাণবিক শক্তি, অথচ জড়তা

পাকিস্তান বিশ্বের একমাত্র মুসলিম পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র। তাদের রয়েছে আধুনিক যুদ্ধবিমান, ব্যালিস্টিক মিসাইল, প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী। তবুও গাজার জন্য তাদের প্রতিরোধ সীমাবদ্ধ ছিল নিন্দা প্রস্তাব আর মানবিক শোকবার্তায়। এমনকি ইসলামাবাদে একটি স্থায়ী সমর্থন মঞ্চ গঠনেও তারা ব্যর্থ হয়েছে।

সৌদি আরব – ইসলামের পবিত্র ভূমি, কিন্তু নিরবতা পাথরের মতো

যেখানে ইসলাম জন্ম নিয়েছিল, সেই ভূমির উত্তরসূরিরা আজ বিলাসিতায় ডুবে থাকা ধনিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। হজ ও উমরাহ আয়োজনকারী দেশ, যার হাজার হাজার কোটি ডলারের রিজার্ভ, তারা ফিলিস্তিনের জন্য না সেনা পাঠিয়েছে, না চিকিৎসা সরঞ্জাম, না প্রকৃত অর্থনৈতিক বা কূটনৈতিক চাপ। বরং, কিছু আরব রাষ্ট্রের মতো তারাও ইসরায়েলের সঙ্গে চুক্তির পথে এগিয়েছে।

মিশর – গাজার প্রতিবেশী, অথচ সীমান্ত বন্ধ

মিশর গাজার একমাত্র "পথ" হতে পারত—রাফাহ সীমান্ত। কিন্তু তাদের সীমান্ত বহুবার বন্ধ করে রাখা হয়েছে। মানবিক সহায়তা আটকে রাখা হয়েছে, খাদ্য, চিকিৎসা সামগ্রী পৌঁছাতে দেয়া হয়নি। তারা নিজ ভূখণ্ডেই একাধিকবার ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের ফেরত পাঠিয়েছে।

আরব আমিরাত, কাতার, বাহরাইন – বিলাসের রাজত্ব, ফিলিস্তিন বিমুখতা

এই উপসাগরীয় দেশগুলোতে রয়েছে ধনসম্পদের পাহাড়, পশ্চিমা প্রযুক্তির প্রতিরূপ, বিলাসী প্রাসাদ আর গ্লোবাল প্রভাব। কিন্তু গাজার জন্য তাদের উদ্যোগ ছিল নামমাত্র। বরং, আমিরাত ও বাহরাইন তো ২০২০ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে "আবরাহাম অ্যাকর্ড" সই করে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেই বসে। ব্যবসা আর রাজনীতির খেলায় গাজার লাশ তাদের বিবেকে আঘাত করতে পারেনি।

তুরস্ক – উচ্চস্বরে বক্তৃতা, কার্যত শূন্য

রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান নেতৃত্বাধীন তুরস্ক নিজেকে উম্মাহর নেতৃস্থানীয় শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে গাজা সংকটে দেখা গেছে—তাদের প্রতিক্রিয়া ছিল গলায় গর্জন, কিন্তু হাতে কোনো রসদ ছিল না। মানবিক ত্রাণ ছাড়া, তুরস্ক কোনো সামরিক, কূটনৈতিক, বা প্রযুক্তিগত সহযোগিতা দেয়নি গাজাবাসীদের।

ইরান – প্রতিরোধের কথা বলে, কিন্তু রাজনীতির কুয়াশা বেশি

ইরান নিজেকে “প্রতিরোধের পৃষ্ঠপোষক” হিসেবে তুলে ধরে, বিশেষ করে হামাস ও হিজবুল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে। কিন্তু বড় পরিসরে বাস্তবিক কোনো সামরিক সাহায্য বা আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগের নির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় না। তাদের কৌশল যেন কেবল নিজেদের আঞ্চলিক আধিপত্য রক্ষায় ব্যস্ত।

ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, বাংলাদেশ – জনতার সমর্থন, কিন্তু সরকারের নিস্ক্রিয়তা

এসব দেশ থেকে জনসাধারণের সমর্থন ছিল প্রচণ্ড। মিছিল, সমাবেশ, অনুদান—সবই হয়েছিল ঘরোয়া পর্যায়ে। কিন্তু সরকারিভাবে জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক মহলে কার্যকর কোনো কূটনৈতিক জোট গঠন হয়নি, এমনকি গাজার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কোনো জোরালো পদক্ষেপও নেয়া হয়নি।

মুসলিম বিশ্বের সেনাবাহিনী – সংখ্যায় বিশাল, কাজে শুন্য

মুসলিম বিশ্বের সেনা সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ। কিন্তু এই বাহিনীগুলো সীমিত কেবল নিজেদের ক্ষমতা সংরক্ষণে, জাতীয় নিরাপত্তা অথবা পশ্চিমা অস্ত্র কোম্পানির সেবায়। ফিলিস্তিনের জন্য তারা কখনো কোনো যৌথ সেনা মহড়া করেনি, এমনকি জাতিসংঘে "সুরক্ষা বলয়" গঠনের প্রস্তাবও দেয়নি।

ওআইসি – ইসলামিক সংহতির ভঙ্গুর মুখোশ

১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ওআইসি (Organization of Islamic Cooperation), যার সদস্য সংখ্যা ৫৭। তাদের মূল উদ্দেশ্যই ছিল মুসলমানদের অধিকার রক্ষা। কিন্তু প্রতি বছরের মতো এবারও তারা দিল 'উদ্বেগ', 'নিন্দা', 'শোক'—কিন্তু একটিও বাস্তব পদক্ষেপ দেখা যায়নি। ওআইসি’র সভা যেন আনুষ্ঠানিকতার প্রতিচ্ছবি।

বিশ্ব মুসলিম মিলিয়নেয়ার ও বিলিওনেয়াররা – একুশ শতকের নির্লজ্জ নিরবতা

ফোর্বসের তালিকায় থাকা শতাধিক মুসলিম ধনকুবের মেটাতে পারতেন গাজার চিকিৎসা, শিক্ষা ও বাসস্থানের প্রয়োজন। কিন্তু এদের অধিকাংশই মুখে না বলেও চুপ থেকে হয়ে উঠেছে নীরব সহযোগী। বিলাসিতা আর বৈশ্বিক বাণিজ্য ছিল তাদের মূল লক্ষ্য, মানবতা নয়।

শেষ কথা: এ নীরবতা ইতিহাসের সাক্ষী

গাজা শুধু এক ভূখণ্ড নয়—এক মানসিক অবস্থা, এক পরীক্ষার নাম। সে পরীক্ষায় মুসলিম বিশ্ব চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তারা পারতো, কিন্তু চায়নি। তারা দেখেছে, কিন্তু চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তারা শুনেছে, কিন্তু কানে তুলেনি।

একদিন, ইতিহাস গাজা নিয়ে শুধু ইসরায়েলের বর্বরতার কথা বলবে না—বলে যাবে পুরো মুসলিম বিশ্বের চরম আত্মপরাজয়ের কথা। তখন লেখা থাকবে এক করুণ সত্য—

"তারা চুপ ছিল। সবাই চুপ ছিল। মৃত্যুর চেয়েও গভীর ছিল সে নীরবতা।"




 

নিউজটি আপডেট করেছেন : Banglar Alo News Admin

কমেন্ট বক্স

প্রতিবেদকের তথ্য

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ